কাঁঠালের উপকারিতা, কাঁঠাল গাছের বৈশিষ্ট্য, কাঁঠাল গাছের পরিচর্যা ও কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি

কাঁঠালের উপকারিতা, কাঁঠাল গাছের বৈশিষ্ট্য, কাঁঠাল গাছের পরিচর্যা ও কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি

নিম্নে কাঁঠালের উপকারিতা, কাঁঠাল গাছের বৈশিষ্ট্য, কাঁঠাল গাছের পরিচর্যা ও কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি সুন্দরভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করা হলো-

(১) কাঁঠালের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

চিত্র- কাঁঠাল
চিত্র- কাঁঠাল
  • বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল (Jackfruit)। এক প্রকারের হলদে রঙের সুমিষ্ট গ্রীষ্মকালীন ফল। বাংলাদেশের সর্বত্র কাঁঠাল গাছ পরিদৃষ্ট হয়।
  • কাঁঠাল এর বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus heterophyllus কাঁচা কাঁঠালকে বলা হয় এঁচোড়।
  • কাঁঠাল গাছের কাঠ আসবাবপত্র তৈরির জন্য অত্যন্ত সমাদৃত। বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা কাঁঠালের উৎপত্তি স্থান হিসেবে বিবেচিত।
  • বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ভারত, বিহার, মিয়ানমার, মালয়, শ্রীলংকা প্রভৃতি এলাকা ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এরূপ ব্যাপক সংখ্যায় কাঁঠালের চাষ করতে দেখা যায় না।
  • লালচে মাটি ও উঁচু এলাকায় এটি বেশি দেখা যায়। ঢাকার উঁচু অঞ্চল, সাভার, ভালুকা, ভাওয়াল ও মধুপুরের গড়, বৃহত্তর সিলেট জেলার পাহাড়ি এলাকা, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপন্ন হয়।

(২) কাঁঠালের উপকারিতা

  • কাঁঠালের পুষ্টিগুণ: কাঁঠাল পুস্তিতে সমৃদ্ধ। এতে আছে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান।
  • কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানবদেহের জন্য বিশেষ উপকারী।
  • কাঁঠাল পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস।
  • এই ফল আঁশযুক্ত হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
  • কাঁঠালে রয়েছে খনিজ উপাদান আয়রন যা দেহের রক্তস্বল্পতা দূর করে।
  • কাঁঠাল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। কোষ খাওয়ার পর যে খোসা ও ভুতরো থাকে তা গবাদি পশুর একটি উত্তম খাদ্য।
  • ভুতরো বা ছোবড়ায় যথেষ্ট পরিমাণে পেকটিন থাকায় তা থেকে জেলি তৈরি করা যায়। এমন কি শাঁস বা পায় থেকে কাঁচা মধু আহরণ করার কথাও জানা গেছে।
  • কাঁঠাল গাছের পাতা গবাদি পশুর একটি খাদ্য। গাছ থেকে মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরি হয়। ফল ও গাছের আঁঠালো কষ কাঠ বা বিভিন্ন পাত্রের ছিদ্র বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
পড়ুন
কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি

(৩) কাঁঠাল গাছের বৈশিষ্ট্য

  • কাঁঠাল গাছ মাঝারি আকারের এবং প্রায় ৮ মিটার লম্বা হতে পারে।
  • রোপণের সাত বছর পরই ফল ধরা শুরু হয়। ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে ফুল আসে।
  • সহবাসী উদ্ভিদ বিধায় একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথকভাবে ধরে। কাণ্ডের গোড়ার দিকে সাধারণত স্ত্রী ফুল এবং গোড়া ও শীর্ষে পুরুষ ফুল ধরে।
  • ছোট অবস্থায় পুষ্পমঞ্জরী দেখেই লিঙ্গ নিরূপণ করা যায়। ফুলের মঞ্জরীর উপরিভাগ নরম ও মসৃণ মনে হয়।
  • স্ত্রী মঞ্জরীর উপরিভাগ দানাদানা ও অমসৃণ হয়। স্ত্রী মঞ্জরিদণ্ড মোটা ও খাটো।
  • পুরুষ ফুল সবুজ নলাকার পুষ্পপুট দ্বারা আবদ্ধ একটি পুংকেশর। ডালের গা বেয়ে ফল ধরে।
  • ফল পাকে মে-আগস্ট মৌসুমে।

(৪) কাঁঠালের জাত

কাঁঠালের বেশ কিছু জাত রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে চাষকৃত জাতসমূহ মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।

গালা ও খাজা এ দুটি জাত ছাড়াও কাঁঠালের আরো জাত আছে। যেমন- রুদ্রাক্ষি, সিঙ্গাপুর, সিলোন, বারোমাসী, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী প্রভৃতি। তন্মধ্যে শুধু হাজারী কাঁঠাল বাংলাদেশে আছে, বাকিগুলো আছে ভারতে।

ক) গালা বা গলা

যখন কাঁঠাল ভালোভাবে পাকে তখন এর অভ্যন্তরে রক্ষিত কোষ অত্যন্ত কোমল ও রসাল প্রকৃতির হয়ে থাকে। কোষ ছোট। পাকার পর একটু লালচে-হলুদাভ হয়। কোষগুলোকে সহজেই আলাদা করা যায়।

খ) খাজা

কোষ আকারে বড় হয়, পাকার পর কম রসাল ও শক্ত বা কচকচে হয়। কোষ চিপলেও সহজে রস বের হয় না। ফ্যাকাশে হলুদ ও স্থান মোটামুটি মিষ্টি হয়।

গ) উচ্চ ফলনশীল জাত

বারি কাঁঠাল-১ এবং বারি কাঁঠাল-২ উচ্চ ফলনশীল এবং সারা দেশে চাষের উপযোগী। মধ্যম সাইজ (৯ কেজি) গাছ প্রতি ১২৫টি ফলসহ ওজন ১১৮০ কেজি পর্যন্ত হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন ১১৮ টন, ৫৫% খাওয়ার যোগ্য এবং টোটাল সলুবুল সলিডস বাটিএসএস ২২%।

পড়ুন
কাঁঠাল চাষে সেচ পদ্ধতি

বারি কাঁঠাল-২ অমৌসুমি ফল। উফশী জাত, মধ্যম সাইজ (৭ কেজি), গাছ প্রতি ৫৪-৭৯টি ফলসহ ওজন ৩৮০-৫৭৯ কেজি হতে পারে। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৮-৫৮ টন, খাদ্য উপযোগী ৬০% এবং টিএসএস ২১%।

(৫) কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি

  1. কাঁঠাল কোন মাটিতে ভালো হয়: পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু ও মাঝারি সুনিষ্কাষিত উর্বর জমি কাঁঠালের জন্য উপযোগী। তবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ, এঁটেল ও কাঁকুরে মাটিতেও এর চাষ করা যায়।
  2. বীজ থেকে কাঁঠালের চারা তৈরি করা হয়। ২/৩ মাসের চারা সতর্কতার সাথে তুলে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়।
  3. গুটি কলম, ডাল কলম, চোখ কলম, চারা কলমের মাধ্যমেও চারা তৈরি করা যায়।
  4. ষড়ভুজী পদ্ধতিতে সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত চারা বা কলম মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য শ্রাবণ মাসে রোপণ করতে হয়।
  5. গাছ ও লাইনের দূরত্ব ১২ মিটার।
  6. রোপণের সময় প্রতি গর্তে গোবর ৩৫ কেজি, টিএসপি সার ২১০ গ্রাম, এমওপি সার ২১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হয়।
  7. বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার। গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে কাঁঠাল চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

(৬) কাঁঠাল গাছের পরিচর্যা

ক) সেচ পানি ব্যবস্থাপনা

  • চারা/কলমের তাড়াতাড়ি বাড়বাড়তির জন্য পরিমিত ও সময় মতো সেচ প্রদান করা দরকার। চারা লাগানোর সাথে সাথে চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে। সকাল-বিকাল দুবার গাছে পানি দিতে হবে।
  • গাছে সার দেওয়ার পরপর পানি দিতে হবে।
  • বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • খরার সময় দুই সপ্তাহ পর পর পানি সেচ দিতে হবে।

খ) বালাই ব্যবস্থাপনা

  • Rhizopus Artocarpi নামের ছত্রাকের আক্রমণে কাঁঠালের মুচি বা ফল পচা রোগ হয়ে থাকে।
  • এ রোগের আক্রমণে কচি ফলের গায়ে বাদামি রঙের দাগের সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ফল শেষ পর্যন্ত ঝরে পড়ে।
  • গাছের পরিত্যক্ত অংশে এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকে এবং তা বাতাসের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
  • গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল পুড়িয়ে ফেলতে হয়। এ রোগ দমনের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করা যেতে পারে।
পড়ুন
কাঁঠাল গাছের বৈশিষ্ট্য এবং কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি ও কাঁঠাল গাছের পরিচর্যা সমূহ

গ) ডাল ছাঁটায় ও আগাছা দমন

অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। গাছের গোড়ার আগাছা তুলে ফেলতে হবে।

(৭) কাঁঠালের বাজার সম্ভাবনা

  • কাঁঠাল খুব উপকারী ফল। কাঁচা কাঁঠাল তরকারি ও পাকা কাঁঠাল ফল হিসেবে খাওয়া যায়। এছাড়া কাঁঠালের বীজ ময়লা ও তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
  • কাঁঠালের পাতা ছাগলের প্রিয় খাদ্য। কাঁঠালের ছোবড়া গরুর খাদ্য।
  • কাঁঠাল কাঠ দিয়ে উন্নতমানের আসবাবপত্র তৈরি করা হয়।
  • কাঁঠাল চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বাড়তি আয় করাও সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।

প্রিয় প্রকৃতি ও বৃক্ষ প্রেমী পাঠক/পাঠিকাবৃন্দ আশা করি উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা আমাদের বাংলাদেশেরে জাতীয় ফল কাঁঠালের উপকারিতা, কাঁঠাল গাছের বৈশিষ্ট্য, কাঁঠাল গাছের পরিচর্যা ও কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন অনেক কিছু অবগত হলাম। আশা করি আলোচনাটি ভালো লাগলে বা অন্য কোন কোন মতামত থাকলে অবশ্য কমেন্ট করে জানাবেন, আপনার প্রতিক্রিয়া আমার কাজে উৎসাহ যোগায়। আমজের মত এখনেই সমাপ্তি। ধন্যবাদ।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লেবু চাষ পদ্ধতি

লেবু চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) লেবুর জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য (২) জারা লেবুর পরিচিতি (৩) লেবু চাষ পদ্ধতি (৩) লেবু চাষে পোকা দমন
পেয়ারার জেলি তৈরির পদ্ধতি বা নিয়ম

পেয়ারার জেলি তৈরির পদ্ধতি/নিয়ম

আলোচ্য বিষয়: নিম্নে পেয়ারার জেলি তৈরি রেসিপি ও পেয়ারার জেলি তৈরির পদ্ধতি/নিয়ম উল্লেখ করা হলো- (১) পেয়ারার জেলি তৈরি রেসিপি (২) পেয়ারার জেলি তৈরির পদ্ধতি/নিয়ম
কমলা চাষ পদ্ধতি

কমলা চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) কমলার জাত (২) কমলা চাষ পদ্ধতি (৩) কমলা চাষে রোগ-বালাই দমন
বেল চাষ পদ্ধতি

বেল চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) বেলের জাত পরিচিতি (২) বেল চাষ পদ্ধতির ধারাবাহিক বর্ণনা
পেয়ারা চাষের পদ্ধতি ও নিয়মসমূহ

পেয়ারা চাষের পদ্ধতি ও নিয়মসমূহ

আলোচ্য বিষয়: (১) পেয়ারার জাতের নাম পরিচিতি (২) পেয়ারা চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম বর্ণনা (৩) পেয়ারা চাষে রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
আনারস চাষ পদ্ধতি

আনারস চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) বাংলাদেশে আনারসের চাষ (২) আনারস চাষ পদ্ধতি
জামরুল ফল চাষের পদ্ধতি

জামরুল ফল চাষের পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) জামরুল ফলের জাত পরিচিতি (২) জামরুল ফল চাষের পদ্ধতি
আমড়া চাষের পদ্ধতি বা আমড়া গাছ চাষ

আমড়া চাষের পদ্ধতি বা আমড়া গাছ চাষ

আলোচ্য বিষয়: (১) আমড়া ফলের জাত পরিচিতি (২) আমড়া চাষের পদ্ধতি বা আমড়া গাছ চাষ
কুল চাষ পদ্ধতি

কুল চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) কুলের জাতগুলো কী কী? (২) কুল চাষ পদ্ধতি বর্ণনা (৩) কুল গাছের পাউডারী মিলডিউ রোগ দমন
রাম্বুতান ফল চাষ

রাম্বুতান ফল চাষ

আলোচ্য বিষয়: (১) রাম্বুতান ফলের পুষ্টিমান (২) রাম্বুতান ফলের জাত পরিচিতি (৩) রাম্বুতান ফল চাষ পদ্ধতি