গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

যেসব প্রাণী অন্য প্রাণীর ওপর আশ্রয় নিয়ে জীবনধারন করে তাকে পরজীবী বলে। গবাদি প্রাণির পরজীবী দ্বারা যেসব রোগ হয় তাদেরকে পরজীবীজনিত রোগ বলে।

গবাদি প্রাণির পরজীবীকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- অন্তঃপরজীবী ও বহিঃপরজীবী। অন্তঃপরজীবী কৃমি নামে পরিচিত আর বহিঃপরজীবী বিভিন্ন পোকা-মাকড়ের নামে পরিচিত যেমন- আঠালি, উকুন, মাছি, মাইটস এবং কেডস ইত্যাদি।

এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- পরজীবীজনিত রোগ কাকে বলে তা জানতে পারবেন। গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগগুলো কি কি তা বলতে পারবেন। গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বিভিন্ন বহিঃপরজীবী জনিত রোগগুলোর লক্ষন, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন।

(১) গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী দমনে চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

এ ধরনের পরজীবী পোষকের দেহের বাইরে থাকে। গবাদি প্রাণির ত্বকে বহিঃদেহের পরজীবী বাস করে গবাদি প্রাণির যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এ জাতীয় পরজীবীর আক্রমণে গবাদি প্রাণির চামড়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

গৃহপালিত গবাদি প্রাণির বহু ধরনের বহিঃদেহের পরজীবীর আক্রমণ হয়ে থাকে। যথা-

আঠালি (Tick): বিভিন্ন ধরনের আঠালি গৃহপালিত গবাদি প্রাণিকে আক্রমণ করে। আঠালি পোষক বা প্রাণীর ত্বকে বাস করে। কোনো কোনো আঠালি একটি পোষক বা প্রাণীর দেহে বাস করে। তাকে একপোষক আঠালি বলে। এরা গবাদি প্রাণির রক্ত চুষে খায়। ফলে রক্তশূন্যতা দেখা যায়।

উকুন (Pediculus): সব ধরনের গবাদি প্রাণিতে বহিঃদেহের পরজীবী পাওয়া যায়। গবাদি প্রাণিতে দু’ধরনের উকুন হয়। যেমন- ক) কামড়ানো উকুন খ) চোষা উকুন। কামড়ানো উকুনের আক্রমণে গবাদি প্রাণির শরীর খুব চুলকায়। ফলে গবাদি প্রাণি শক্ত জিনিসের সাথে শরীর ঘষে ক্ষতের সৃষ্টি করে। চোষা উকুন গবাদি প্রাণির ত্বকের রক্ত চুষে খায় এবং গবাদি প্রাণি রক্তশূন্যতায় ভোগে।

পড়ুন
ছাগলের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কী করতে হবে?

মাছি: গৃহপালিত প্রাণিকে বিভিন্ন ধরনের মাছি আক্রমণ করে থাকে। যেমন- মহিষের মাছি, আস্তাবলের মাছি, ঘোড়ার মাছি, উড়ন্ত মাছি ইত্যাদি। মাছি গবাদি প্রাণির ত্বকে বসে রক্ত চুষে খায়। মাছি সাধারণত গবাদি প্রাণির দেহের ক্ষতে বসে সেখানে ডিম পাড়ে, ডিম হতে লার্ভা হয়, ফলে মাছি যাতে পচন ধরে, ক্ষত শুকায় না এবং ক্ষতে বিভিন্ন রোগজীবানু সংক্রামিত হয়ে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে। ক্ষতে বসলে সেসব স্থান চুলকায়। গবাদি প্রাণি সেসব স্থান শক্ত কিছুর সাথে ঘষে বা জিহ্বা দিয়ে চেটে ঘা আরও বাড়িয়ে দেয়। গবাদি প্রাণির খাওয়া এবং দুধ প্রদানে মাছি ব্যাঘাত ঘটায়।

মাইটস: মাইটস গবাদি প্রাণির শরীরের সংক্রামক চর্মরোগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত গবাদি প্রাণির সংস্পর্শে বা গবাদি প্রাণির ব্যবহার্য আসবাপত্র বা বিছানার মাধ্যমে পরজীবী সুস্থ গবাদি প্রাণিতে সংক্রামিত হয়ে বিভিন্ন চর্মরোগের সৃষ্টি করে। গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্যহানি ঘটে, কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। গবাদি প্রাণির শরীর চুলকায়, ফলে গবাদি প্রাণি শক্ত জিনিসের সাথে শরীর ঘষায় এবং ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

কেডস: ছাগল ও ভেড়ায় এ জাতীয় পরজীবী বেশি পাওয়া যায়। এরা আঠালির মত গবাদি প্রাণির রক্ত চুষে খায় এবং আক্রমণে শরীর খুব চুলকায়। ফলে শক্ত বস্তুর সাথে ঘষলে ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ:

  1. বহিঃদেহের পরজীবীর আক্রমণ হতে রক্ষা করতে হলে গবাদি প্রাণিকে নিয়মিত শরীর ঘষে গোসল করাতে হবে।
  2. বহিঃদেহের পরজীবী ধ্বংসের জন্য ‘টক্সেফেন’, ‘নেগুভন’, ‘এসানটল’, ‘নিওসিডোল’ ইত্যাদি ঔষধ স্প্রে করা যেতে পারে। প্রতি ২.৫ লিটার পানিতে ৪-৫ গ্রাম মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে গবাদি প্রাণির দেহ ধুয়ে দিতে হবে।
  3. গবাদি প্রাণি ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
  4. ঘরের মেঝেতে এবং চারপাশে ‘ফিনাইল’, ‘নেগুভন বা আইওসান’ মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
পড়ুন
ছাগলের বসন্ত গোট পক্স রোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার নিয়ম, রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

(২) গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগ ‘মেন্জ’ (Mange) এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

রোগের কারণ: মাইট।

রোগের লক্ষণ:

  1. দেহে তীব্র চুলকনি হয় এবং জ্বালা করে।
  2. অতিরিক্ত চুলকানির ফলে গবাদি প্রাণির চামড়ায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
  3. ক্ষতে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য চামড়ায় ঘা হয়।
  4. ঘায়ে চটা ধরে চুলসহ উঠে আসে।

রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

  1. আক্রান্ত গবাদি প্রাণিকে ‘লিনডেন (০.২%)’ পানিতে মিশিয়ে ২-৩ দিন গোসল করালে মেঞ্জ ভালো হয়।
  2. ব্রোমসাইক্লিন’ স্প্রে বা ডাস্টিং হিসেবে প্রয়োগ করেও মেঞ্জ রোগের চিকিৎসা করা যায়। অথবা গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

(৩) গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগ ‘মায়াসিস’ (Myiasis) এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

রোগের কারণ: মাছি।

রোগের লক্ষণ:

  1. গবাদি প্রাণি রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
  2. খাদ্য গ্রহণে বিঘ্ন ঘটে। গবাদি প্রাণির ওজন দিন দিন কমতে থাকে।
  3. শরীরে ঘা হয় এবং শুকাতে দেরি হয়।

রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

  1. ক্ষতস্থান ভালভাবে ধুুয়ে ‘সকেটিল পাউডার’ লাগেেত হবে।
  2. মাছির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ঘায়ের চারিদিকে ‘তারপিন তেল’ দৈনিক ৩-৪ বার প্রয়োগ করতে হবে।

উপরোক্ত আলোনাটির মাধ্যমে আমরা গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানলাম।

বহু পরজীবী গৃহপালিত গবাদি প্রাণির ওপর জীবনধারণ করে। এসব পরজীবী যে সব প্রাণীর ওপর জীবনধারন করে তাদের কোনো উপকার করে না বরং অনেক ক্ষতিসাধন করে থাকে।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উন্নত গাভী গরুর খামার পরিকল্পনা (Gavi Palon Bangladesh)

উন্নত গাভী গরুর খামার পরিকল্পনা (Gavi Palon Bangladesh)

আলোচ্য বিষয়: আলোচ্য বিষয়: (১) উন্নত গাভী গরুর খামার পরিকল্পনা কেন প্রয়োজন? (২) দুধের গরুর খামার গড়তে প্রাথমিক প্রস্তুতি (৩) গাভীর খামারের স্থান নির্বাচন (৪) উন্নত জাতের দুধের গাভীর নাম (৪) উন্নত জাতের গাভীর প্রাপ্তিস্থান (৫) উন্নত জাতের গাভী চেনার উপায় বা বৈশিষ্ট্য (৬) গাভীর পরিচর্যা (৭) গর্ভবতী গাভীর যত্ন: গাভীর গর্ভকালীন পরিচর্যা ও প্রসব পরবর্তী গাভীর যত্ন (৮) দুগ্ধবতী গাভীর যত্ন (৯) দুধের গরুর খাবার তালিকা (১০) স্বাস্থ্যসম্মত উন্নত জাতের গাভী পালন ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা
সাবধান, এই জিনিসগুলি আপনার গরুর ফিডে মেশানো হতে পারে

সাবধান! এই জিনিসগুলি আপনার গরুর ফিডে মেশানো হতে পারে

আলোচ্য বিষয়: কিভাবে গরুর ফিডে ভেজাল হতে পারে?
বড় গরুর খামার পরিকল্পনাঃ পণ্য বিক্রি কিভাবে, কোথায়, মূল্য নির্ধারণ, বাজারজাত ও অন্যান্য

বড় গরুর খামার পরিকল্পনাঃ পণ্য বিক্রি কিভাবে, কোথায়, মূল্য নির্ধারণ, বাজারজাত ও অন্যান্য বিবেচ্য বিষয় সমূহ

আলোচ্য বিষয়: (১) বাণিজ্যিক বড় গরুর খামার এর ঝুকি সমূহ (২) পণ্য বিপণন বা বাজারজাতকরণ (৩) বাণিজ্যিক বড় গরুর খামার এর প্রধান প্রধান বাজারজাতকরণ চ্যানেলসমূহ (৪) খামারের পণ্যের মূল্য যে সকল বিষয়ের উপর নির্ভর করে
গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ

আলোচ্য বিষয়: (১) গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী দমনে চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ (২) গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগ ‘মেন্জ’ (Mange) এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ (৩) গরু-ছাগলের গায়ে পোকা বা বহিঃপরজীবী জনিত রোগ ‘মায়াসিস’ (Myiasis) এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ
গরু পালন পদ্ধতি, পরিচর্যা, গোয়ালঘর, খাদ্য, রোগ পরিচিতি ও ব্যবস্থাপনা

গরু পালন পদ্ধতি, পরিচর্যা, গোয়ালঘর, খাদ্য, রোগ পরিচিতি ও ব্যবস্থাপনা

আলোচ্য বিষয়: (১) গরু পালন পদ্ধতি (২) গরুর পরিচর্যা (৩) গরু পালনের জন্য একটি আদর্শ গোয়াল ঘর (৪) গরুর খাদ্য ব্যবস্থাপনা (৫) গরুর বিভিন্ন প্রকার রোগ পরিচিতি (৬) গরুর রোগ ব্যবস্থাপনা
গরুর ভিটামিন ইনজেকশন

গরুর ভিটামিন ইনজেকশন

আলোচ্য বিষয়: (১) গরুর ভিটামিন ইনজেকশন এর নাম (২) গরুকে দ্রুত মোটাতাজা করতে গরু মোটাতাজাকরণ ইনজেকশন ও গরু মোটাতাজাকরণ ভিটামিন প্রয়োগ পদ্ধতি
গরু খাবার খায় না, অ্যানোরেক্সিয়া, ৩টি গরু না খাওয়ার কারণ জানুন

গরু খাবার খায় না (অ্যানোরেক্সিয়া): ৩টি গরু না খাওয়ার কারণ জানুন

আলোচ্য বিষয়: (১) গরুর বদহজম বা ফুড পয়জনিং হলে গরু খায় না (২) নাইট্রেট পয়জনিং হলে গরু খাবার খায় না (৩) ইনফেক্সাস ডিজিজ অথবা কিটোসিস হলে গরু খাবার খায় না
মোটাতাজাকরণ গরু পালন প্রশিক্ষণ, গরু পালনের পদ্ধতি ও গরু পালনের নিয়ম

মােটাতাজাকরণ গরু পালন প্রশিক্ষণ, গরু পালনের পদ্ধতি ও গরু পালনের নিয়ম

আলোচ্য বিষয়: এখানে আমরা আলোচনা করব মােটাতাজাকরণ গরু পালন প্রশিক্ষণ পর্বের গরু পালনের পদ্ধতি ও গরু পালনের নিয়মসমূহ সম্পর্কে। তো চলুন শুরু করা যাক।
গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি

গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি (সংক্ষিপ্ত ধারণা)

আলোচ্য বিষয়: (১) গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য ৪টি বিষয় (২) গরু মোটাতাজাকরণের জন্য খড়ের সাথে ইউরিয়া মিশিয়ে গো-খাদ্য তৈরি
১০টি গাভী পালনে আয় ব্যয় কত, গাভী পালনে লাভ কেমন

১০টি গাভী পালনে আয় ব্যয় কত? গাভী পালনে লাভ কেমন? (বাজার দরঃ ২০২০)

আলোচ্য বিষয়: (১) দশটি গাভী পালনে ব্যয় কত? (২) দশটি গাভী পালনে দুধ বিক্রি করে আয় কত? (৩) দশটি গাভী পালনে লাভ কেমন?