বর্গী কোন ভাষার শব্দ? বর্গী কাদের বলা হতো বা হয়? বর্গী কারা তারা কি করেছিল?

বাংলার ইতিহাসে ‘বর্গী’ শব্দটি একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই শব্দটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক সত্তার নাম নয়, বরং বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং লোককথাতেও এর গভীর প্রভাব রয়েছে। কিন্তু ‘বর্গী’ শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসেছে? বর্গী কারা ছিল? তারা কী করেছিল? এই ব্লগ পোস্টে আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। আমাদের লক্ষ্য হলো এই বিষয়টিকে সহজবোধ্য, তথ্যবহুল উপায়ে উপস্থাপন করা, যাতে পাঠকরা সম্পূর্ণ ধারণা পান।
(১) বর্গী কোন ভাষার শব্দ?

‘বর্গী’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বেশ কিছু মতভেদ থাকলেও সর্বাধিক গৃহীত মত অনুসারে, এটি মারাঠি ভাষার ‘বারগির’ শব্দের অপভ্রংশ। ‘বারগির’ শব্দটি মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের অশ্বারোহী সৈন্যদের বোঝাতো, যাদের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র সম্রাট বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হতো।
কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, ‘বারগির’ শব্দটির মূল ফারসি শব্দ ‘বার্গীর’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বোঝা নেওয়া’ বা ‘যিনি বোঝা বহন করেন’। মোগল সেনাবাহিনীতেও এই শব্দটি অশ্বারোহীদের জন্য ব্যবহৃত হতো। তবে বাংলায় এই শব্দটি মারাঠি ভাষা থেকে এসে প্রচলিত হয়েছে বলে বেশিরভাগ সূত্র একমত।
মারাঠি ভাষার প্রভাব:
মারাঠি ভাষা ভারতের মহারাষ্ট্র অঞ্চলের প্রধান ভাষা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষার কিছু শব্দ বাংলায় প্রবেশ করে। ‘বর্গী’ শব্দটি এমনই একটি উদাহরণ। মারাঠি ‘বরচি’ (বর্শা) থেকে ‘বারগির’ শব্দটি এসেছে, যা পরে বাংলায় ‘বর্গী’ হিসেবে রূপান্তরিত হয়।
(২) বর্গী কারা তারা কি করেছিল?

ক) বর্গী কারা
বর্গী ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের একটি অশ্বারোহী সৈন্যদল, যারা লুটতরাজ এবং আক্রমণের জন্য বিখ্যাত ছিল। এরা মূলত মারাঠি ধনগর জাতিগোষ্ঠীর সদস্য ছিল, যারা তাদের দ্রুতগামী ঘোড়া এবং যুদ্ধকৌশলের জন্য পরিচিত ছিল। বর্গীরা মারাঠা সাম্রাজ্যের সম্রাটের কাছ থেকে ঘোড়া, অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পেত।
বর্গীদের সামরিক কাঠামো:
বর্গীদের সাথে তুলনা করা যায় মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের আরেকটি সৈন্যদল ‘শিলাদার’দের সঙ্গে। তবে শিলাদাররা নিজেদের ঘোড়া এবং অস্ত্রের ব্যয় বহন করত, যেখানে বর্গীদের জন্য এই সুবিধা রাষ্ট্র প্রদান করত। এই কারণে বর্গীরা ছিল আরও সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী।
ধনগর সম্প্রদায়ের ভূমিকা:
ধনগর ছিল মারাষ্ট্রের একটি যাযাবর সম্প্রদায়, যারা তাদের সাহসিকতা এবং যুদ্ধকৌশলের জন্য বিখ্যাত। বর্গীদের অধিকাংশই এই সম্প্রদায় থেকে আসত। তারা অভিযানে যাওয়ার সময় ন্যূনতম সরঞ্জাম বহন করত—একটি সাত হাত লম্বা কম্বল এবং একটি বর্শা। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় ‘বরচি’ বলা হতো, যা থেকে ‘বারগির’ নামটির উৎপত্তি।
খ) বর্গীরা কী করেছিল?
বর্গীদের ইতিহাস বাংলার ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় দশ বছর ধরে তারা বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিয়মিত লুটতরাজ চালিয়েছে। এই সময়ে বর্গী আক্রমণ একটি বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
বর্গী আক্রমণের পটভূমি:
১৭৪০ সালে আলিবর্দী খান বাংলার নবাব হন। তার ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে সরফরাজ খানের শ্যালক রুস্তম জং মারাঠা রাজা রঘুজী ভোঁসলের সমর্থন চান। এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে মারাঠারা বাংলায় আক্রমণ শুরু করে। বর্গীরা এই অভিযানের মূল শক্তি ছিল।
বর্গীদের লুটতরাজ:
বর্গীরা বাংলার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ চালাত। তারা বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম এবং উড়িষ্যার মতো অঞ্চল দখল করে নেয়। এমনকি তারা মুর্শিদাবাদ আক্রমণের চেষ্টাও করেছিল, যদিও তাতে তারা সফল হয়নি। বর্গীদের নির্মম অত্যাচারে বহু মানুষ তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়, এমনকি গঙ্গার পূর্বাঞ্চলের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষও তাদের লুটপাটের শিকার হয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব:
বর্গী আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেশমি কাপড়ের বাজার (আড়ং) লোকশূন্য হয়ে পড়ে। খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। বর্গীরা ‘চৌথ’ নামে খাজনা আদায় করত, যা ছিল মারাঠি ভাষায় করের একটি রূপ।
নবাব আলিবর্দী খানের প্রতিরোধ:
নবাব আলিবর্দী খান বর্গীদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ১৭৪৫ সালে কাটোয়ায় এবং ১৭৪৬ সালে তিনি বর্গীদের পরাজিত করেন। পরবর্তীতে তিনি মেদিনীপুর থেকে বর্গীদের বিতাড়িত করেন। তার কৌশলগত প্রতিরোধের ফলে বর্গী আক্রমণ ধীরে ধীরে কমে যায়।
(৩) বর্গীদের সাংস্কৃতিক প্রভাব
বর্গীদের আক্রমণ বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বাংলার লোকসংগীত ও ছড়ায় বর্গীদের ভয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত ছড়া-
“ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে?”
এই ছড়াটি বর্গীদের লুটতরাজ এবং তাদের খাজনা আদায়ের ভয়াবহতার প্রতিচ্ছবি।
সাহিত্যে বর্গী:
অষ্টাদশ শতাব্দীর বর্গী আক্রমণকে বাংলা সাহিত্যে গণহত্যা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, “বর্গী শব্দটি এখন বাইরে থেকে আগত লুটেরাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।” লোকগানে এবং মা-ঠাকুমার গল্পে বর্গী শব্দটি ভীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘বর্গী’ শব্দের ব্যবহার:
আধুনিক বাংলায় ‘বর্গী’ শব্দটি প্রায়ই রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বহিরাগত বা ক্ষতিকারক শক্তিকে ‘বর্গী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
(৪) বর্গীদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
বর্গী আক্রমণ বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি শুধুমাত্র মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের বিস্তারই প্রকাশ করে না, বরং মোগল শাসনের দুর্বলতাকেও তুলে ধরে। বর্গীদের আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থায় যে ক্ষতি হয়েছিল, তা পুনরুদ্ধার করতে বহু বছর লেগেছিল।
মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তার:
বর্গী আক্রমণ মারাঠা সাম্রাজ্যের শক্তি এবং কৌশলগত দক্ষতার প্রমাণ। তারা দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে তাদের লুটতরাজের প্রকৃতি তাদের শত্রুদের কাছে ঘৃণার পাত্র করে তুলেছিল।
(৫) শেষকথা
‘বর্গী’ শব্দটি মারাঠি ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ স্থান দখল করেছে। বর্গীরা ছিল মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের অশ্বারোহী সৈন্য, যারা অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় লুটতরাজ চালিয়েছিল। তাদের আক্রমণ বাংলার অর্থনীতি ও সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলেও, তাদের নাম বাংলার লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।
তো বন্ধু, আশা করি উপরোক্ত একটি সহজ ও সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি পড়ে আপনি- বর্গী কোন ভাষার শব্দ? বর্গী কাদের বলা হতো বা হয়? বর্গী কারা তারা কি করেছিল? প্রভৃতি বিষয় সম্পের্কে একটি ধারণা লাভ করতে পেরেছেন। আজ এখানেই ইত টানছি।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।