গরুকে কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর বা ইনজেকশন দেওয়ার নিয়ম কি?

আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় খামারি ভাইজানেরা। গরু পালনের ক্ষেত্রে কৃমিনাশক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক খামারির মধ্যে কৃমিনাশক নিয়ে কম ধারণা রয়েছে। এই পোস্টে আমরা কৃমিনাশক সম্পর্কিত সকল আরও জানব, কৃমিনাশকের প্রয়োগের ব্যবহারের সময়, আগে-পরে করণীয় ও নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব।
(১) গরুকে কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর নিয়মসমূহ
গরু/ছাগলকে কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর বা ইনজেকশন দেওয়ার ১০টি সাধারন নিয়মাবলি–
- কৃমির ঔষধ সাধারণত সকালে খালি পেটে সেব্য।
- বাচ্চা হওয়ার পর গাভীকে কৃমিনাশক ঔষধ দেওয়া যাবে না। এতে দুধ শুকিয়ে যাবে।
- প্রাণিকে প্রজনন করার ৪৫ দিনের মধ্যে ঔষধ না খাওয়ানোই ভাল ।
- গরুর ক্ষেত্রে ৭-৮ মাসের উপরে গর্ভবতী, ছাগলের ক্ষেত্রে ৩ মাসের উর্দ্ধে কৃমির ঔষধ না দেওয়া উত্তম।
- কৃমির ঔষধ নিয়মিত ৪ মাস পরপর উভয় কলিজা ও গোলকৃমির কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে।
- কৃমিনাশক ঔষধ স্বাভাবিক ডোজ থেকে কোনক্রমে কম হলে কাজ হবে না ।
- কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানোর পর ২-৪ ঘণ্টা খাবার দেওয়া উচিত না।
- কৃমিনাশক ঔষধ প্রাণিকে অত্যন্ত গরমের মধ্যে খাওয়ানো যাবে না। পেটে কৃমি না থাকলেও কৃমির ঔষধ খাওয়ালে ক্ষতি করবে না।
- প্রতিরোধ হিসেবে নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ মাত্রাতিরিক্ত হলে ক্ষতি হয় না।
- কৃমিনাশক ঔষধ ব্যবহার করার পূর্বে অবশ্যই প্রাণির পায়খানা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে খাওয়ানো উচিত।
(২) গরুর কৃমির ওষুধ এর ডোজ
কৃমিনাশকের সঠিক নিয়ম হলো-
- প্রতি ১ মণ (৪০ কেজি) ওজনের জন্য ১টি কৃমিনাশক ট্যাবলেট দিতে হবে।
- যদি ওজন ১ মণ ১ কেজি হয়, তবে ২টি ট্যাবলেট দিতে হবে।
- লাইভ ওজনের ক্ষেত্রে, প্রতি ৭০ কেজি ওজনের জন্য ১টি ট্যাবলেট। যদি ওজন ৭১ কেজি হয়, তবে ২টি ট্যাবলেট প্রয়োজন।
অনেকে মনে করেন কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ালে গরু অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। এটি ভুল। মাঠ পর্যায়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, এবং কোনো গবেষণায় এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।
(৩) গরুকে কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর আগে ও পরে করণীয়
- খালি পেটে খাওয়ানো: কৃমিনাশক সকালে খালি পেটে খাওয়ানো উত্তম।
- খাওয়ানোর পর: ১-২ ঘণ্টা গরুকে খালি পেটে রাখতে হবে। এরপর সাদা পানি দেওয়ার চেষ্টা করুন। পানি গ্রহণ না করলেও সমস্যা নেই।
- খাবার: ২ ঘণ্টা পর গরুকে দানাদার বা স্বাভাবিক খাবার দেওয়া যাবে।
- এনজাইম পাউডার: যেদিন কৃমিনাশক দেওয়া হবে, সেদিন জাইমোট বা খুজবিটের মতো এনজাইম পাউডার খাওয়ালে গরুর খাবারের রুচি ঠিক থাকবে।
(২) গাভী বাচ্চা প্রসবের পর কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর নিয়ম
গাভী বাচ্চা প্রসবের পর কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর বিষয়টি গাভীর স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এটি করার সময় এবং পদ্ধতি নির্ভর করে গাভীর শারীরিক অবস্থা এবং কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব গাভী বাচ্চা প্রসবের কতদিন পর কৃমির ঔষধ দেওয়া যায় এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ক) গাভীকে কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর সঠিক সময়
গাভী বাচ্চা প্রসবের পর কৃমির ঔষধ দেওয়ার উপযুক্ত সময় নির্ভর করে গাভীর শারীরিক অবস্থার উপর। সাধারণত, নিম্নলিখিত নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়-
- স্বাস্থ্যবান গাভী:
- যদি গাভী সুস্থ এবং শারীরিকভাবে সবল থাকে, তবে বাচ্চা প্রসবের পরের দিন থেকেই কৃমির ঔষধ দেওয়া যেতে পারে। তবে, সাধারণত ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে দেওয়া নিরাপদ এবং কার্যকর।
- এই সময়ে গাভীর শরীরে কৃমির ঔষধ কাজ করতে পারে এবং এটি গাভীর পাকস্থলী বা অন্যান্য অঙ্গের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে না।
- অসুস্থ বা দুর্বল গাভী:
- যদি গাভী অসুস্থ বা দুর্বল হয়, তবে কৃমির ঔষধ দেওয়ার আগে অবশ্যই একজন পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অসুস্থ গাভীর ক্ষেত্রে ঔষধ দেওয়ার সময় ১৫ দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত, যতক্ষণ না গাভী শারীরিকভাবে স্থিতিশীল হয়।
- গাভীর রুক্ষ পশম, পুষ্টির অভাব, বা অন্যান্য অসুস্থতার লক্ষণ দেখা গেলে ঔষধ দেওয়ার আগে তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
- কৃমির ঔষধের কার্যকারিতা:
- কৃমির ঔষধ সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত করতে গাভীর মল পরীক্ষা করা যেতে পারে। যদি ঔষধ দেওয়ার পরও কৃমির সমস্যা থেকে যায়, তবে পশুচিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে ঔষধের ডোজ বা ধরন পরিবর্তন করা প্রয়োজন হতে পারে।
খ) কৃমির ঔষধের প্রভাব
গাভীর শরীরে তিনটি প্রধান গহ্বর (cavity) রয়েছে-
- থোরাসিক গহ্বর (Thoracic Cavity): এখানে ফুসফুস এবং হৃদপিণ্ড থাকে।
- এবডোমিনাল গহ্বর (Abdominal Cavity): এখানে পাকস্থলী (রুমেন) এবং অন্যান্য পরিপাকতন্ত্রের অঙ্গ থাকে।
- পেলভিক গহ্বর (Pelvic Cavity): এখানে প্রজনন অঙ্গগুলো থাকে।
কৃমির ঔষধ সাধারণত পাকস্থলীতে কাজ করে এবং প্রজনন অঙ্গের উপর কোনো সরাসরি প্রভাব ফেলে না। তাই বাচ্চা প্রসবের পরপরই ঔষধ দেওয়া নিরাপদ, যদি গাভী শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে। তবে, ঔষধ দেওয়ার আগে গাভীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
গ) গাভীর পুনরাবৃত্তি প্রজনন সমস্যা (Repeat Breeding)
অনেক ক্ষেত্রে গাভী বাচ্চা প্রসবের পর পুনরাবৃত্তি প্রজনন সমস্যা দেখা দেয়, যেমন গাভী বীজ গ্রহণের পরও গর্ভধারণ না করা। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন-
- টাইমিংয়ের সমস্যা: গাভীর হিটের সময় সঠিকভাবে বীজ দেওয়া না হলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, গাভী যদি সকালে হিটে আসে, তবে বীজ দেওয়ার উপযুক্ত সময় হবে ১২ ঘণ্টা পরে, অর্থাৎ সন্ধ্যায়। ভুল সময়ে বীজ দেওয়া হলে গাভী পুনরায় হিটে আসতে পারে।
- পুষ্টির অভাব: গাভীর শরীরে পুষ্টির অভাব থাকলে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। এজন্য সুষম খাদ্য, কাঁচা ঘাস, এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক নিশ্চিত করতে হবে।
- কৃমির সমস্যা: কৃমির উপদ্রব গাভীর স্বাস্থ্য এবং প্রজনন ক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই নিয়মিত কৃমির ঔষধ দেওয়া জরুরি।
সমাধানের উপায়-
- পশুচিকিৎসকের পরামর্শ: যদি গাভী দুই বা ততোধিক বার বীজ গ্রহণের পরও গর্ভধারণ না করে, তবে একজন অভিজ্ঞ পশুচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন। গাভীর শারীরিক অবস্থা এবং লক্ষণ পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে।
- সঠিক খাদ্য ও পরিচর্যা: গাভীকে কাঁচা ঘাস, পর্যাপ্ত পানি, এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করুন। এছাড়া, গাভীকে সূর্যালোকের সংস্পর্শে আনুন, যা তার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- মল পরীক্ষা: গাভীর মল এবং শ্লেষ্মা (mucus) পরীক্ষা করে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা নির্ণয় করা যায়। যদি মল স্বাভাবিক থাকে এবং শ্লেষ্মা পরিষ্কার থাকে, তবে গাভীর প্রজনন সমস্যা কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঘ) গাভীর স্বাস্থ্য পরিচর্যার টিপস
- নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ:
- গাভীকে নিয়মিত কৃমির ঔষধ দেওয়া উচিত। বাচ্চা প্রসবের পর ৭-১৫ দিনের মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া যেতে পারে, এবং পরবর্তীতে ৩-৬ মাস পরপর ঔষধ দেওয়া যেতে পারে।
- সাধারণত ব্যবহৃত কৃমিনাশক ঔষধের মধ্যে রয়েছে অ্যালবেনডাজল, ফেনবেনডাজল, বা আইভারমেকটিন। তবে, ঔষধের ডোজ এবং ধরন নির্ধারণের জন্য পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- পুষ্টিকর খাদ্য:
- গাভীকে সুষম খাদ্য সরবরাহ করুন, যেমন কাঁচা ঘাস, ভুট্টার গুঁড়ো, খৈল, এবং মিনারেল সাপ্লিমেন্ট। এটি গাভীর শারীরিক শক্তি এবং প্রজনন ক্ষমতা বাড়ায়।
- পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করুন, কারণ পানিশূন্যতা গাভীর স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- পরিষ্কার পরিবেশ:
- গাভীর থাকার জায়গা পরিষ্কার এবং শুকনো রাখুন। এটি কৃমির সংক্রমণ এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
- গাভীর শারীরিক অবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা করুন। রুক্ষ পশম, ক্ষুধামান্দ্য, বা অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গেলে তৎক্ষণাৎ পশুচিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
(৩) শেষ কথা
গাভী বাচ্চা প্রসবের পর কৃমির ঔষধ দেওয়ার সঠিক সময় নির্ভর করে তার শারীরিক অবস্থার উপর। সাধারণত ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ঔষধ দেওয়া নিরাপদ, তবে গাভী দুর্বল হলে ১ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। গাভীর পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখলে গর্ভধারণের সমস্যা কমে আসবে এবং খামারে সফলতা আসবে।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।




