গরু-ছাগলের চর্মরোগঃ ডার্মাটোফিলোসিস এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়

গরু এবং ছাগলের চর্মরোগ বা ডার্মাটোফিলোসিস একটি সাধারণ রোগ, যা পশুপালনকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এই রোগটি Dermatophilus congolensis নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। সকল জাতের ও বয়সের গবাদিপ্রাণী এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এটি ত্বকের ব্যাপক প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা প্রাণির স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই ব্লগ পোস্টে ডার্মাটোফিলোসিসের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
(১) গরু-ছাগলের চর্মরোগ ডার্মাটোফিলোসিস (Dermatophilosis) কী?
ডার্মাটোফিলোসিস একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত চর্মরোগ, যা Dermatophilus congolensis নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এই রোগটি গরু, ছাগল, ভেড়া এবং অন্যান্য গবাদিপ্রাণীদের ত্বকে আক্রমণ করে। আর্দ্র পরিবেশ এবং ত্বকের ক্ষত এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এটি প্রাণির ত্বকে খোস-পাঁচড়া, প্রদাহ এবং লোমের ক্ষতি ঘটায়।
(২) গরু-ছাগলের চর্মরোগ ডার্মাটোফিলোসিস এর কারণ
ডার্মাটোফিলোসিসের প্রধান কারণ হলো Dermatophilus congolensis ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া ত্বকের ক্ষত বা আর্দ্র পরিবেশে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। নিম্নলিখিত কারণগুলো এই রোগের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে-
- আর্দ্র পরিবেশ: বর্ষাকালে বা আর্দ্র এলাকায় এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
- ত্বকের ক্ষত: পোকামাকড়ের কামড়, আঁচড় বা অন্যান্য ক্ষত ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করে।
- দুর্বল ইমিউন সিস্টেম: অপুষ্টি বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা প্রাণীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
- বাহ্যিক পরজীবী: মাছি, মশা বা অন্যান্য পরজীবী ত্বকের ক্ষত সৃষ্টি করে, যা রোগ ছড়াতে সহায়তা করে।
(৩) গরু-ছাগলের চর্মরোগ ডার্মাটোফিলোসিসের লক্ষণ
এই রোগের লক্ষণগুলো প্রাণির ত্বকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। নিচে প্রধান লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হলো-
- ত্বকে খোস-পাঁচড়া (Scab): আক্রান্ত স্থানে লোম বিবর্ণ হয়ে যায় এবং Paint brush এর মতো ক্ষত সৃষ্টি হয়।
- হর্নি লেয়ার: প্রাপ্তবয়স্ক গরুতে ত্বকে ক্রিম থেকে বাদামী রঙের শক্ত স্তর (Horney layer) তৈরি হয়।
- ত্বকের প্রদাহ ও Exudation: আক্রান্ত ত্বকে প্রদাহ দেখা দেয় এবং তরল নিঃসরণ (Exudation) হয়।
- আঁঠালো পীতাভ তরল: ক্ষতের আবরণ উঠালে আঁঠালো হলুদাভ তরল দেখা যায়, যা রোগের একটি স্পষ্ট লক্ষণ।
এই লক্ষণগুলো সাধারণত প্রাণির পিঠ, পেট, পা এবং মাথার ত্বকে বেশি দেখা যায়।
(৩) গরু-ছাগলের চর্মরোগ ডার্মাটোফিলোসিসের চিকিৎসা
ডার্মাটোফিলোসিসের চিকিৎসার জন্য সময়মতো এবং সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে চিকিৎসার বিস্তারিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো-
ক) অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতে কার্যকর। প্রচলিত কিছু ইঞ্জেকশন হলো:
- Inj. Steptocillin 2.5gm (Techno)
- Inj. Sp vet 2.5gm (ACME)
- Inj. Streptopen 2.5gm (Renata)
- Inj. Strepto-P 2.5gm (ACI)
ব্যবহারের নিয়ম: মাংসপেশীতে দিনে একবার ইঞ্জেকশন দিতে হবে, মোট ৫ দিন।
অথবা,
- Inj. Dexa SP 50ml
ব্যবহারের নিয়ম: ১০-২০ মিলি মাংসপেশীতে দিনে একবার, ৩-৪ দিন।
খ) অ্যান্টিহিস্টামিনিক ইঞ্জেকশন
অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি অ্যান্টিহিস্টামিনিক ইঞ্জেকশন প্রদাহ এবং অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। প্রচলিত ইঞ্জেকশনগুলো হলো:
- Inj. Anithista Vet 10ml (Square)
- Inj. Histavet 10, 100ml (ACI)
- Inj. Astavet 10ml, 100ml (ACME)
- Inj. Niravet 10ml, 100ml (Opsonin)
ব্যবহারের নিয়ম: ১০০ কেজি ওজনের প্রাণির জন্য ৫-১০ মিলি মাংসপেশীতে দিনে একবার, ৩-৫ দিন।
গ) বাহ্যিক চিকিৎসা
ত্বকের ক্ষতের জন্য বাহ্যিক চিকিৎসা অত্যন্ত কার্যকর। উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলো হলো:
- Powder Negutox 20gm (Chemist)
ব্যবহারের নিয়ম: পাউডারটি নারিকেল তেলের সাথে মিশিয়ে মলম তৈরি করে আক্রান্ত স্থানে দিনে ৩-৪ বার লাগাতে হবে, মোট ৫-৭ দিন।
অথবা,
- CuSO4 বা ZnSO4 সলুশন: ০.৩-০.৫% ঘনত্বের কপার সালফেট বা জিঙ্ক সালফেট সলুশন দিয়ে ক্ষতস্থান কয়েকদিন ধুয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
(৪) গরু-ছাগলের চর্মরোগ ডার্মাটোফিলোসিস প্রতিরোধের উপায়
ডার্মাটোফিলোসিস প্রতিরোধে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নিচে প্রতিরোধের কিছু কার্যকর উপায় উল্লেখ করা হলো-
- বাহ্যিক পরজীবী নিয়ন্ত্রণ: মাছি, মশা বা অন্যান্য পরজীবী নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত পশুর ত্বক পরিষ্কার এবং কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
- সুষম খাদ্য সরবরাহ: প্রাণিকে ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে, যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- স্বাস্থ্যকর বাসস্থান: প্রাণিদের শুষ্ক, পরিষ্কার এবং বায়ুচলাচলযুক্ত বাসস্থানে রাখতে হবে।
- আক্রান্ত প্রাণির পৃথকীকরণ: আক্রান্ত প্রাণিকে অন্যান্য সুস্থ প্রাণি থেকে আলাদা রাখতে হবে।
- ত্বকের ক্ষত প্রতিরোধ: ত্বকে আঁচড় বা ক্ষত হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।
(৫) ডার্মাটোফিলোসিসের প্রভাব
এই রোগটি শুধুমাত্র প্রাণির ত্বকের ক্ষতি করে না, বরং তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতার উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গরুর দুধ উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং ছাগলের মাংসের গুণগত মান হ্রাস পেতে পারে। তাই, সময়মতো চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডার্মাটোফিলোসিস গরু-ছাগলের একটি গুরুতর চর্মরোগ, যা Dermatophilus congolensis ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। এর লক্ষণগুলো সহজেই শনাক্ত করা যায় এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিরাময় করা সম্ভব। তবে প্রতিরোধই এই রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। পশুপালনকারীদের উচিত সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা এবং সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পশুপালন ব্যবসায় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।





