গরু-ছাগলের ধনুষ্টংকার (Tetanus) রোগঃ লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

ধনুষ্টংকার বা টিটেনাস একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যা গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া এবং এমনকি মানুষের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে এই রোগটি বিশেষ করে বাছুর এবং ছাগলের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই ব্লগ পোস্টে ধনুষ্টংকার রোগের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এটি পড়ে পশুপালকরা তাদের পশুদের এই ভয়ানক রোগ থেকে রক্ষা করতে পারবেন।
(১) টিটেনাস রোগ (Tetanus) কী?
টিটেনাস একটি গুরুতর রোগ, যা ‘ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটানি’ নামক গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এই ব্যাকটেরিয়ার টক্সিন পশুর স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে, যার ফলে পেশী শক্ত হয়ে যায় এবং খিঁচুনি দেখা দেয়। এই রোগ পশুর মস্তিষ্ক ও নার্ভের উত্তেজনা বাড়ায়, যা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
(২) কীভাবে গরু-ছাগলের মধ্য টিটেনাস রোগ ছড়ায়?
টিটেনাসের জীবাণু সাধারণত পশুর মলের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়ায়। গরু ও ঘোড়ার অন্ত্রে এই জীবাণু থাকতে পারে। পশুর শরীরে কোনো কাটা বা ক্ষত থাকলে, এই জীবাণু সেই ক্ষতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে দুর্ঘটনাজনিত আঘাত, শিং ভাঙা, নাভীতে ক্ষত, বাচ্চা প্রসব, অস্ত্রোপচার বা খোঁজা করার সময় এই জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। ঘোড়ার মল এই রোগের জীবাণুর একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
রোগের উৎপত্তির সময়কাল সাধারণত কয়েক দিন থেকে ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।
(৩) গরু-ছাগলের টিটেনাস রোগের লক্ষণ
টিটেনাসে আক্রান্ত পশুদের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়-
- পেট ফাঁপা: পশুর পেট ফুলে ওঠে এবং শক্ত হয়ে যায়।
- জ্বর: পশুর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
- হাঁটতে অসুবিধা: পশু বেশি হাঁটতে পারে না এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
- পেশী শক্ত হওয়া: পেশীতে কম্পন এবং খিঁচুনি দেখা দেয়।
- শব্দে সংবেদনশীলতা: যেকোনো শব্দে পশু কেঁপে ওঠে।
- মাড়ি আটকে যাওয়া: লক-জব হওয়ায় পশু খেতে বা জাবর কাটতে পারে না।
- খাদ্য ও পানি গিলতে অসুবিধা: লক-জবের কারণে পশু পানি বা খাবার গিলতে পারে না।
- ঘাড় ও পায়ের গিরা শক্ত হওয়া: পশুর ঘাড় এবং পায়ের জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়।
- তৃতীয় অক্ষিপত্র ঝুলে পড়া: পশুর চোখের তৃতীয় পাতা ঝুলে যায়।
- লালা পড়া: মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা ঝরে।
এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে পশু ৬-৭ দিনের মধ্যে না খেয়ে মারা যেতে পারে, যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়।
(৪) গরু-ছাগলের টিটেনাস রোগের চিকিৎসা
টিটেনাসের চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা জরুরি। নিচে চিকিৎসার ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো-
ক) ক্ষতের চিকিৎসা
- অ্যান্টি-টক্সিন ইনজেকশন: ক্ষত থাকলে Inj. ATS (1500 Unit) প্রতিদিন ১ বার করে ৩-৫ দিন ক্ষতের বিষ নষ্ট করার জন্য ইনজেকশন দিতে হবে। অথবা প্রথম দিনেই টিটেনাস অ্যান্টিটক্সিন (১,০০,০০০ ইউনিট) পেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে।
- ক্ষত পরিষ্কার: Hydrogen Peroxide দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে Sulid Vet Powder, Sumid-Vet Powder বা Nilamide Powder ব্যবহার করতে হবে। এই পাউডারগুলো ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করতে হবে।
খ) পেনিসিলিন ইনজেকশন
- বড় পশুর জন্য: Inj. Penicillin G Sodium (10 Lac vial) বা Inj. Pen-G ব্যবহার করতে হবে। বড় গরুর ক্ষেত্রে ১২ ঘণ্টা পরপর ২০-৩০ লাখ ইউনিট পেনিসিলিন পেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে।
- কম্বিনেশন ইনজেকশন: Inj. Combipen, Inj. Pronacillin, Inj. Bipen-Vet বা Inj. Vetopen ব্যবহার করা যেতে পারে। ডোজঃ প্রতি ১০ কেজি ওজনে ০.২-০.৫ মিলি, ৫০ কেজি ওজনে ১.০-২.২৫ মিলি, এবং ১০০ কেজি ওজনে ২-৫ মিলি গভীর পেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে। লক্ষণ দূর হওয়ার পর আরও ২ দিন ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
গ) উত্তেজনা কমানোর জন্য
- ক্লোরপ্রোমাজিন ইনজেকশন: Inj. Largactil (50mg/2ml) বা Inj. Opsonil (50mg/2ml) ব্যবহার করতে হবে। ডোজঃ প্রতি কেজি ওজনে শিরায় ০.৪ মি.গ্রা বা পেশীতে ১ মি.গ্রা হিসেবে ১২ ঘণ্টা পরপর ৭-১২ দিন ইনজেকশন দিতে হবে।
ঘ) তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ
- পশুর চামড়া কেটে গেলে Inj. A.T.S (1500 Unit) একটি ইনজেকশন পেশীতে দিতে হবে।
(৫) গরু-ছাগলের ধনুষ্টংকার বা টিটেনাস প্রতিরোধের উপায়
টিটেনাস প্রতিরোধে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। নিচে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ দেওয়া হলো-
- ক্ষত পরিষ্কার রাখা: পশুর শরীরে কোনো ক্ষত হলে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। Hydrogen Peroxide বা অন্যান্য অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- অন্ধকার ঘরে রাখা: আক্রান্ত পশুকে একাকী এবং শান্ত অন্ধকার ঘরে রাখতে হবে, যাতে শব্দ বা আলোতে উত্তেজিত না হয়।
- নরম খাবার: পশুর পায়খানা নরম রাখতে এমন খাবার দিতে হবে, যা হজমে সহায়ক।
- টিকা দেওয়া: ক্ষত, প্রসব বা খোঁজা করার সময় T.T. বা Tetavax ইনজেকশন দেওয়া উচিত। এটি টিটেনাস প্রতিরোধে কার্যকর।
টিটেনাস একটি প্রাণঘাতী রোগ, যা দ্রুত চিকিৎসা না করলে পশুর মৃত্যু অনিবার্য। পশুপালকদের জন্য এই রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত টিকা, ক্ষত পরিষ্কার রাখা এবং পশুর পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
গরু-ছাগলের ধনুষ্টংকার রোগ একটি ভয়ানক সমস্যা, তবে সঠিক জ্ঞান এবং সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পশুপালকদের উচিত কোনো ক্ষত বা আঘাতের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিয়মিত টিকা প্রয়োগ করা। এই ব্লগ পোস্টে দেওয়া তথ্যগুলো পশুপালনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এবং পশুদের সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখবে।
আপনার পশুদের সুস্থতার জন্য আজই সতর্ক হোন এবং টিটেনাসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন!
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।



