গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগঃ কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগ একটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যা গবাদি পশুর স্বাস্থ্য ও খামারের উৎপাদনশীলতার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই রোগটি প্রধানত সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়, যা বিশেষ করে নবজাতক বাছুর ও ছাগলের বাচ্চাদের মধ্যে ব্যাপক হারে দেখা যায়। এই ব্লগ পোস্টে সালমোনেলোসিস রোগের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং তথ্যবহুল এই নির্দেশিকা খামারিদের এই রোগ মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
(১) গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগ কী?
সালমোনেলোসিস হলো সালমোনেলা জাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। এই রোগটি গরু, ছাগল, ভেড়া এবং অন্যান্য গবাদি পশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নবজাতক পশুদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। রোগটি পশুর দেহে বিভিন্ন উপায়ে প্রবেশ করে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
(২) গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগের কারণ
সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া প্রধানত রোগাক্রান্ত পশুর মলের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়ায়। এই জীবাণু মাটিতে ১০ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। দূষিত পানি, খাদ্য, এবং পরিবেশের মাধ্যমে এটি পশুর দেহে প্রবেশ করে। নবজাতক পশুদের ক্ষেত্রে নাভীর মাধ্যমেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- দূষিত খাদ্য ও পানি: পশুর খাদ্য বা পানিতে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া মিশে গেলে রোগ ছড়ায়।
- পরিবেশ দূষণ: অপরিচ্ছন্ন খামারে জীবাণু সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।
- বাহক পশু: রোগাক্রান্ত পশু থেকে সুস্থ পশুতে সংক্রমণ হয়।
(৩) গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগের লক্ষণ
সালমোনেলোসিস রোগের লক্ষণ পশুর দেহে তিনটি প্রধান আকারে প্রকাশ পায়: সেপ্টিসেমিক, তীব্র আন্ত্রিক সংক্রমণ এবং দীর্ঘমেয়াদি আন্ত্রিক সংক্রমণ।
ক) সেপ্টিসেমিক
- পশুর শরীরে প্রচণ্ড জ্বর দেখা দেয়।
- প্রচণ্ড চাপে পশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ক্ষুধামন্দা দেখা যায়।
- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হলে চলাফেরায় অসুবিধা এবং দৃষ্টি বিভ্রাট হয়।
- মারাত্মক ডায়রিয়ার কারণে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, যার ফলে পশু শুকিয়ে যায় এবং দুই দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটতে পারে।
- রক্তের মাধ্যমে জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে সেপ্টিসেমিয়া সৃষ্টি করে।
খ) তীব্র আন্ত্রিক সংক্রমণ
- পশুর দেহে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দেখা দেয়।
- প্রচণ্ড জ্বর বা তীব্র ডায়রিয়ার কারণে গর্ভবতী পশুর গর্ভপাত ঘটতে পারে।
- মলে রক্ত ও মিউকাস দেখা যায়।
- কঠিন পানিশূন্যতা এবং টক্সিমিয়ার কারণে পশু দাঁড়াতে পারে না এবং ৫০-৭৫% ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে।
গ) দীর্ঘমেয়াদি আন্ত্রিক সংক্রমণ
- ক্ষুধামন্দা এবং দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া দেখা যায়।
- মল হলুদাভ বা রক্তমিশ্রিত পাতলা হয়, মিউকাসও থাকতে পারে।
- পশু দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যায় এবং ওজন কমে যায়।
(৪) গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি
সালমোনেলোসিস রোগের চিকিৎসার জন্য সঠিক ওষুধ এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আরও কার্যকর। নিম্নে চিকিৎসার কিছু কার্যকর পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো-
ক) ট্রাইমেথোপ্রিম ও সালফামিথোক্সাজল সংযুক্ত ওষুধ
- ওষুধের নাম: Bolus Politrim-Vet, Bolus Cidacot, Bolus Trigin, Bolus Cotrim-Vet, Bolus Sulphatrim।
- ব্যবহারের নিয়ম:
- বাছুর, ছাগল, ভেড়ার জন্য প্রতি ২০ কেজি ওজনের জন্য ০.৫ বোলাস বা ৮০ কেজি ওজনের জন্য ২টি বোলাস।
- প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পর পর ৫-৭ দিন সেবন করাতে হবে।
- লক্ষণ দূর হওয়ার পর আরও ২ দিন ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
খ) ট্রিপল সালফোনামাইড ও স্ট্রেপটোমাইসিন সংযুক্ত ওষুধ
- ওষুধের নাম: Bolus Strepto-Plus, Bolus Trimycin-Vet, Bolus Diatrim, Bolus Trios।
- ব্যবহারের নিয়ম: প্রতি ৩৫ কেজি ওজনের জন্য ১টি বোলাস ৫ দিন ধরে।
গ) সালফাডিমিডিন সংযুক্ত ইনজেকশন
- ওষুধের নাম: Inj. Dimidin, Inj. Diadin, Inj. Sulphasol-Vet, Inj. Salidone, Inj. SMP 25 Coophavet।
- ব্যবহারের নিয়ম:
- প্রথম দিন প্রতি ৫০ কেজি ওজনের জন্য ১৫-৩০ মিলিলিটার শিরায় বা মাংসপেশীতে।
- পরবর্তী দিন থেকে প্রথম দিনের মাত্রার অর্ধেক হিসেবে ৫ দিন।
- SMP 25 এর ক্ষেত্রে প্রথম দিন প্রতি ৫ কেজি ওজনের জন্য ১ মিলিলিটার, পরবর্তীতে ৭-১০ কেজি ওজনের জন্য ১ মিলিলিটার ৪৮ ঘণ্টা পর পর।
ঘ) অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন
- ওষুধের নাম: Inj. Oxytet, Inj. Oxymycin, Inj. Oxyvet, Inj. Tetravet, Inj. Otetra-Vet।
- ব্যবহারের নিয়ম: প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১০ মিলিগ্রাম বা ৫ কেজি ওজনের জন্য ১ মিলিলিটার মাংসপেশী বা চামড়ার নিচে ৫ দিন।
ঙ) পানিশূন্যতার জন্য স্যালাইন
- মুখে খাওয়ার স্যালাইন: Sachet Electro Plus, Advance-Vet Saline, Sachet Glucolyte, Chemolyte Plus Powder-Vet, Electro Pack।
- ব্যবহারের নিয়ম: ১ গ্রাম স্যালাইন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে বারবার খাওয়াতে হবে। তৈরি দ্রবণ ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।
- ইনজেকশন স্যালাইন: Inj. Diasol I.V Fluide, Inj. Koloride, Inj. Cholera Saline।
- ব্যবহারের নিয়ম: জগুলার ভেইনে মিনিটে ৬০ ফোটা হারে প্রয়োগ করতে হবে।
(৫) গরু-ছাগলের সালমোনেলোসিস রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
সালমোনেলোসিস রোগ প্রতিরোধে সঠিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে কিছু কার্যকর প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো-
- পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: গর্ভবতী গাভীকে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত স্থানে প্রসব করাতে হবে।
- জীবাণুমুক্ত খাদ্য: নবজাতক পশুর খাবার জীবাণুমুক্ত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
- নতুন পশুর জন্য পৃথক স্থান: নতুন ক্রীত পশুকে খামারে আনার পর পৃথক স্থানে রাখতে হবে।
- মল-মূত্র ব্যবস্থাপনা: পশুর মল ও মূত্র যেন খাদ্য ও পানি দূষিত না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
- বাহক পশুর চিকিৎসা: রোগাক্রান্ত পশুকে পৃথক রেখে চিকিৎসা করতে হবে।
- নিয়মিত জীবাণুনাশক ব্যবহার: খামারে ফিনাইল বা ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা: খামারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ সবসময় বেশি কার্যকর। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে সালমোনেলোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব। এটি শুধু পশুর স্বাস্থ্যই রক্ষা করে না, বরং খামারের অর্থনৈতিক ক্ষতিও কমায়।
সালমোনেলোসিস গরু-ছাগলের জন্য একটি মারাত্মক রোগ, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা ও প্রতিরোধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। খামারিদের উচিত সঠিক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই ব্লগ পোস্টে উল্লিখিত তথ্যগুলো খামারিদের এই রোগ মোকাবিলায় সহায়ক হবে। নিয়মিত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে খামারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।




