চাষাবাদ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর
 
		চাষাবাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মূল চালিকাশক্তি। বেগুন, পেঁপে, কলা ইত্যাদি ফসলের চাষ নিয়ে কৃষকদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে, যেমন চাষের পদ্ধতি, ফলের রঙের পরিবর্তন, বা রোগ প্রতিরোধের উপায়। এই ব্লগে আমরা চাষাবাদ সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করব।
১. বেগুনের চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে কেউ বলবেন কী?
উত্তর: 
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বেগুনের চাষ হয়ে থাকে। উন্নত জাত ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে না জেনে, গবেষণায় প্রাপ্ত নিয়ম ও সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশি ফলনের পাশাপাশি খরচও কমিয়ে আনা যায়।
আসুন ধাপে ধাপে জেনে নিই বেগুন চাষের পদ্ধতি–
১। মাটি নির্বাচন: হালকা বেলে থেকে ভারী এটেল মাটি অর্থাৎ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই বেগুনের চাষ করা হয়। হালকা বেলে মাটি আগাম জাতের বেগুন চাষের জন্য উপযোগী। এই ধরণের মাটিতে বেগুন চাষ করতে হলে প্রচুর পরিমাণ জৈবসারসহ অন্যান্য সার ঘন ঘন প্রয়োগ করতে হবে। এঁটেল দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি বেগুন চাষের জন্য উপযোগী এবং এই মাটিতে বেগুনের ফলন বেশি হয়। বেগুন চাষের জন্য নির্বাচিত মাটি গভীর, উর্বর ও সুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন।
২। চাষের মৌসুম: বাংলাদেশের জলবায়ুতে বছরের যে কোনো সময়েই বেগুনের চাষ করা যেতে পারে। তবে রবি মৌসুমে বেগুন চাষ করলে ফলন খরিপ মৌসুমের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। রবি মৌসুম অর্থাৎ শীতকালের জন্য সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। খরিপ মৌসুম অর্থাৎ বর্ষাকালীন বেগুনের জন্য জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। রবি মৌসুমে চাষের জন্য যে কোনো জাতের বেগুন লাগানো যেতে পারে, কিন্তু খরিপ মৌসুমে চাষের জন্য বারমাসী জাতসমূহ লাগাতে হবে।
৩। চারা তৈরি: বেগুন চাষের জন্য প্রথমে বীজতলায় চারা করে তা মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। বীজতলা এমন স্থানে তৈরি করতে হবে যেখানে বৃষ্টির পানি দাঁড়াবে না অর্থাৎ সুনিষ্কাশিত হতে হবে, সর্বদা আলো-বাতাস পায় অর্থাৎ ছায়ামুক্ত হতে হবে।
৪। বীজতলা তৈরি: বীজতলা তৈরির জন্য মাটি গভীরভাবে (অন্তত ২০ সেন্টিমিটার) চাষ দিতে হবে। বীজতলায় মাটি হতে হবে উর্বর।
উর্বরতা কম থাকলে জৈব সার ও সামান্য পরিমাণ ফসফেট জাতীয় সার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি বর্গ মিটার বীজতলার জন্য ০.১০ ঘন মিটার পচা গোবর সার ও ৩০ গ্রাম টিএসপি সার ব্যবহার করা যেতে পারে। চাষের পর সম্পূর্ণ জমিকে কয়েকটি ছোট ছোট বীজতলাতে ভাগ করে নিতে হবে।
প্রতিটি বীজতলা দৈর্ঘ্যে ৩-৫ ঘন মিটার, প্রস্থে এক মিটার ও পাশ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা রাখা উচিত। পাশাপাশি দুটো বীজতলার মধ্যে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা রাখা উচিত। এ ফাঁকা জায়গা থেকে মাটি নিয়ে বীজতলা উঁচু করে নিতে হবে। অল্প সংখ্যক চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা হিসেবে কাঠের বাক্স, প্লাস্টিকের ট্রে অথবা বড় টব ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রতি হেক্টর জমিতে বেগুন চাষের জন্য ২৫০-৩০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। ১ গ্রাম বেগুন বীজে প্রায় ২০০-২৫০ টি বীজ থাকে এবং শতকরা ৭৫-৮০টি বীজ অঙ্কুরিত হয়। বীজতলাতে বীজ ছিটিয়ে বা সারি করে বোনা যেতে পারে। সারিতে বুনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫ সেমি. দিতে হবে।
বীজ বোনার পর বীজতলার মাটি হালকা করে চেপে দিতে হবে। বীজতলাতে চারার দূরত্ব ২-৩ সেমি. হলে চারার বৃদ্ধি ভালো হয়। বীজ বোনার পর ঝাঝরি দিয়ে হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে সেচ দেওয়া দরকার। প্রয়োজন হলে, শুকনা খড় বা পলিথিন শীট বা বস্তা দিয়ে বীজতলা ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। গ্রীষ্মকালে সকালে ও সন্ধ্যায় হালকাভাবে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। চারা গজানোর পর ২-৩ দিন অন্তর হালকা সেচ দেওয়া উচিত।
৫। জমি তৈরি ও চারা রোপণ: সাধারণত মাঠের জমি তৈরির জন্য ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। ৩৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণের উপযোগী হয়। এ সময় চারাতে ৫-৬টি পাতা গজায় এবং চারা প্রায় ১৫ সেমি. লম্বা হয়। বেগুনের চারার বয়স একটু বেশি হলেও লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে দু’মাস পর্যন্ত চারা বীজতলায় রেখে দেওয়া যায়। চারা তোলার সময় যাতে শিকড় নষ্ট না হয় সেজন্য চারা তোলার ১-২ ঘণ্টা আগে বীজতলায় পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে।
৬। দূরত্ব: সাধারণত বড় আকারের বেগুনের জাতের ক্ষেত্রে ৯০ সেমি. দূরে সারি করে সারিতে ৬০ সেমি. ব্যবধানে চারা লাগানো যেতে পারে এবং ক্ষুদ্রাকার জাতের ক্ষেত্রে ৭৫ সেমি. সারি করে সারিতে ৫০ সেমি. ব্যবধানে চারা লাগানো যেতে পারে।
৭। সময়: জমিতে লাগানোর পর পরই যাতে চারা শুকিয়ে না যায় সে জন্য সম্ভব হলে বিকালের দিকে চারা লাগানো উচিত।
৮। সার প্রয়োগ: বেগুন মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উপাদান শোষণ করে। এজন্য বেগুনের সন্তোষজনক উৎপাদন সার ব্যতীত সম্ভব নয়। সারের পরিমাণ মাটির উর্বরতা শক্তির উপর নির্ভর করে। বেগুন চাষের জন্য হেক্টর প্রতি নিম্নলিখিত পরিমাণে সার সুপারিশ করা যেতে পারে। প্রথম কিস্তি সার চারা লাগানোর ১০-২৫ দিন পর, দ্বিতীয় কিস্তি ফল ধরা আরম্ভ হলে এবং তৃতীয় ফল তোলার মাঝামাঝি সময়ে দিতে হবে। জমিতে রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে।
৯। পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা: বেগুনের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হল বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। কোনো কোনো এলাকায় ক্ষুদ্র লাল মাকড় প্রধান শত্রু। এছাড়া কাঁটালে পোকা বা ইপলাকনা বিট্ল, জাব পোকা, ছাতরা পোকা, বিছা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, থ্রিপস, কাটুই পোকা ইত্যাদি বেগুনের ক্ষতি করে থাকে। আইপিএম পদ্ধতিতে এসব পোকা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
১০। রোগ ব্যবস্থাপনা: এ দেশে বেগুনের ঢলে পড়া ও গোড়া পচা দু’টি মারাত্মক রোগ। প্রায় বেগুন ক্ষেতেই এ রোগ দেখা যায়। ফল পচা রোগেও অনেক বেগুন নষ্ট হয়। বীজতলায় ড্যাম্পিং অফ রোগ চারার মড়ক সৃষ্টি করে। এছাড়া মোজাইক, ক্ষুদে পাতা, শিকড়ে গিঁট ইত্যাদি রোগও বেগুন ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে।
১১। ফল সংগ্রহ ও ফলন: সাধারণত ফুল ফোটার পর ফল পেতে গড়ে প্রায় ১ মাস সময় লাগে। জাত ভেদে হেক্টর প্রতি ১৭-৬৪ টন ফলন পাওয়া যায়। ফল সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই সংগ্রহ করতে হবে। ফল যখন পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয় অথচ বীজ শক্ত হয় না তখন ফল সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয়। সংগ্রহের সময় ফলের ত্বক উজ্জ্বল ও চকচকে থাকবে। অধিক পরিপক্ক হলে ফল সবুজাভ হলুদ অথবা তামাটে রং ধারণ করে এবং শাঁস শক্ত ও স্পঞ্জের মত হয়ে যায়।
২. পেঁপে পাকলে হলুদ হয় কেন?
উত্তর: 
রং হলো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। পেঁপের বর্ণ হলুদে রূপান্তর বলতে-পেঁপের মধ্যে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হলুদ বর্ণধারী নতুন যৌগের সৃষ্টিকে বোঝায়।
প্রাকৃতিকভাবেই উদ্ভিদ কান্ডের মুকুলে ইনডোল অ্যাসিটিক এসিড উৎপন্ন হয়, যা থেকে এক পর্যায়ে ইথিলিন গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং এই গ্যাসের প্রভাবে পেঁপের জৈব-রাসায়নিক পদার্থগুলো পরিবর্তিত হয় এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে। মূলত এটি একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এ কারণে পেঁপে পাকলে হলুদ হয়।
৩. অনেক সময় বেগুন ঢলে পড়ে যায়, এই রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা কী?
উত্তর: 
বেগুনের ঢলে পড়ে যাওয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিম্নরূপ-
লক্ষণ সমূহ:
- Ralstonia solanacearum নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
- যেকোন বয়সের গাছে এই রোগের আক্রমণ হতে পারে।
- আক্রান্ত গাছ হঠাৎ ঢলে পড়ে অর্থাৎ সকালে সুস্থ ও বিকালে ঢলে পড়ে। ২-৩ দিন পরে গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
- প্রাথমিক অবস্থায় গাছের শিকড় আক্রান্ত হয়। ফলে জীবাণু গাছকে মাটি থেকে পানি গ্রহণ ও সঞ্চালনে বাধা প্রদান করে এবং গাছ ঢলে পড়ে মারা যায়।
- মাঝে মাঝে আক্রান্ত গাছের নিচের পাতার শিরা ঝলসে যেতে দেখা যায়।
- আক্রান্ত ডাল/কাণ্ড কেটে পরিষ্কার পানিতে রাখলে সাদা সুতার মতো মাইসেলিয়াম ডুবানো প্রান্ত থেকে বের হয়।
প্রতিরোধের উপায়:
- আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে সোলানেসি পরিবারের (বেগুন, টমেটো, আলু, মরিচ ইত্যাদি) ২-৩ বছর চাষ না করা।
- জমি তৈরির সময় দানাদার কীটনাশক (ফুরাডান/কার্বোফুরান) ৩ কেজি/একর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- চারা রোপণের ২০-২৫ দিন আগে ব্লিচিং পাউডার ২.৬ কেজি/বিঘা শেষ চাষে ব্যবহার করতে হবে।
- আক্রান্ত গাছে কপার অক্সিক্লোরাইড (সানভিট/কুপ্রাভিট) ৪ গ্রাম/লিটার পানি অথবা বর্দোমিকচার (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম পাথুরে চুন ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- ৭-১০ লিটার পানিতে ১ গ্রাম স্ট্রেপ্টোমাইসিন/প্লাটোমাইসিন মিশিয়ে তাতে চারা ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে উপকার পাওয়া যায়।
৪. অনেক সময় কলার পাতা জ্বলসে যেতে দেখা যায়। এটা কি রোগ এবং এর লক্ষণ ও প্রতিকার কী?
উত্তর: 
কলার পাতা ঝলসে যাওয়া হলো কলার সিগাটোকা রোগ।
এ রোগের লক্ষণ এবং প্রতিকার নিম্নরূপ-
লক্ষণ সমূহ:
- প্রাথমিকভাবে ৩য় বা ৪র্থ পাতায় ছোট ছোট হলুদ দাগ দেখা যায়।
- ক্রমশ দাগগুলো বড় হয় ও বাদামি রং ধারণ করে।
- একাধিক দাগ বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং পাতা পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়।
প্রতিকারে করণীয়:
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ ও আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলা।
- দূরত্ব বজায় রেখে চারা রোপণ করা, বাগানের আশেপাশে মুড়ি গাছ না রাখা।
- সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করা, পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখা।
- আক্রান্ত গাছের সাকার ব্যবহার না করে Tissue culture sucker ব্যবহার করা।
- ক্যাবরিওটপ ৩ গ্রাম অথবা, টিল্ট-২৫০ ইসি ০.৫ মি.লি অথবা, অটোস্টিন ২ গ্রাম অথবা, পোটেন্ট ২৫০ ইসি = ১ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করা।
চাষাবাদের সফলতা নির্ভর করে সঠিক জ্ঞান ও কৌশলের উপর। এই ব্লগে আলোচিত বেগুনের চাষ পদ্ধতি, পেঁপের রঙের পরিবর্তন, এবং ফসলের রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো কৃষকদের জন্য মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করবে। আশা করি, এই প্রশ্নোত্তরগুলো আপনার চাষাবাদের অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করবে এবং ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। কৃষি জ্ঞান অর্জনের এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখুন। ‘ইনফরমেশন বাংলা’ এর সাথেই থাকুন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।



