ফসল বিন্যাস কাকে বলে? ফসল বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা

ফসল বিন্যাস কাকে বলে, ফসল বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা

এ আলোচনাটির মাধ্যমে আপনি- ফসল বিন্যাস কাকে বলে, ফসল বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ সম্পর্কে জানতে পারবেন। ফসল বিন্যাসের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো জানতে পারবেন।

(১) ফসল বিন্যাস কাকে বলে?

ফসল বিন্যাস কাকে বলে: কোন এলাকায় প্রতি বছর ১২ মাস সময়ে মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদনে অনুসরণকৃত ধারাকে ফসল বিন্যাস বলা হয়। ফসল বিন্যাসকে কোন এলাকার শস্যোৎপাদন ধারা বা শস্যচাষ বলা হয়।

উদাহরণস্বরূপ- কোন এলাকার খরিপ-১ (১৬ ফেব্রুয়ারি-১৫ জুন) মৌসুমে পাট, খরিপ-২ (১৬ জুন-১৫ অক্টোবর) মৌসুমে আমন ধান ও রবি (১৬ অক্টোবর-১৫ ফেব্রুয়ারি) মৌসুমে গম আবাদ হলে উক্ত এলাকার ফসল বিন্যাস: পাট→আমন ধান→গম।

ফসল বিন্যাস দেশের সকল এলাকায় একই রকম নয়। ফসল বিন্যাসের এ ভিন্নতা অনেকগুলি উপাদান দ্বারা নির্ধারিত বা প্রভাবিত হয়ে থাকে।

(২) ফসল বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান

ফসল বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলিকে প্রধানত ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়-

  1. জলবায়ুগত উপাদান (Climatic factors)
  2. মৃত্তিকাগত উপাদান (Edaphic factors)
  3. আর্থ-সামাজিক উপাদান (Socio-economic factors)

ক) জলবায়ুগত উপাদান

সাধারণত কোন একটি ফসল তার চাহিদা অনুযায়ী তাপমাত্রা, পানি, সূর্যালোক, দিবাদৈর্ঘ্য, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি জলবায়ুর উপাদানসমূহ যে অঞ্চলে পায় সেই এলাকাতেই অভিযোজিত হয়ে থাকে।

এলাকা ও মৌসুমভিত্তিক অভিযোজিত/খাপ খাওয়ানো ফসলসমূহ হতে অন্যান্য উপাদান বিবেচনায় কিছু ফসল নির্বাচিত হয়ে যায়।

রবি মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলে নিম্নতাপমাত্রায় গম উৎপাদন ভালো হওয়ায় ঐ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকার ফসল বিন্যাসে গম স্থান পেয়েছে।

খ) মৃত্তিকাগত উপাদান

কোন ফসলের সুষ্ঠু-স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও সর্বোচ্চ ফলনের সক্ষমতা নির্ভর করে প্রয়োজনীয় জলবায়ুগত পরিবেশ ও উপযুক্ত মাটির উপর। জলবায়ুগত উপাদান অনুকূল হলেও মাটির গুণাগুণ ভালো না হলে উক্ত ফসল কাঙ্খিত ফলন দিতে ব্যর্থ হয়।

See also  সূর্যমুখী চাষ পদ্ধতি

মাটির গুণাগুণ, বন্ধুরতা, বুনট, আর্দ্রতা, লবণাক্ততা, অম্লমান (pH), খাদ্যোৎপাদনের প্রাপ্যতা প্রভৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

চর এলাকার মাটি হালকা বুনট হওয়ায় সাধারণত ঐ সকল এলাকার ফসল বিন্যাসে তরমুজ, বাদাম, মিষ্টি আলু জাতীয় ফসল দেখা যায়।

অম্লীয় মাটিতে চা, আনারস ভালো হয়।

উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত মাটিতে সব ধরনের ফসল জন্মায় না। তবে নারিকেল, সুপারী, স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয়।

উচু বা মাঝারী উচু এলাকায় চাষাবাদের জন্য অনেক ফসল নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও হাওড় বা নীচু এলাকায় জলি আমন ছাড়া অন্য ফসল লাগানোর সুযোগ থাকে না।

গ) আর্থ-সামাজিক উপাদান

কোন এলাকার জলবায়ু ও মাটি অনেক ফসলের জন্য অনুকূল হলেও কিছু ফসল ঐ এলাকার কৃষকরা নির্বাচন করে যার সাথে উক্ত এলাকায় জনগণের আর্থিক ও সামাজিক কিছু উপাদান জড়িত। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য, এলাকাভিত্তিক ফসলের চাহিদা, বাজারমূল্য, বিপনন ব্যবস্থা, কৃষকের আর্থিক অবস্থা, ফসল আবাদের উপকরণের প্রাপ্যতা, ঋণ ব্যবস্থা, ফসল সংরক্ষণ সুবিধা, পরিবহণ সুবিধা, খাদ্যাভাস, সরকারী নীতিমালা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রভৃতি।

এক সময় এ বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় ফসল বিন্যাসে খরিপ-১ মৌসুমে পাট থাকলেও এখন কম। কারণ আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় এবং বাজারমূল্য কম হওয়ায় কৃষক পাট চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে পাট শস্যোৎপাদন ধারা থেকে বাদ পড়েছে।

ভাত নির্ভর খাদ্য তালিকার জন্য প্রায় সব এলাকায় ধান একটি সাধারণ ফসল। কৃষক তার নিজের পারিবারিক খাদ্য নিশ্চয়তার জন্য ধান নির্বাচন করে থাকে।

এলাকার কৃষকদের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে লাভজনক যে কোন ফসল চাষের উদ্যোগ নিতে পারে কিন্তু আর্থিক সংকট থাকলে কম পুজিতে হয় এমন ফসলই ঐ এলাকায় চাষাবাদ করতে দেখা যায়।

কোল্ডস্টোরেজ থাকলে ঐ সকল এলাকায় কৃষকরা আলু চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে।

শহরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ফসল বিন্যাসে লাভজনক শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।

See also  সরিষা কোন মাটিতে ভালো হয়? সরিষা চাষ পদ্ধতি ও বিঘা প্রতি সরিষার ফলন

(৩) ফসল বিন্যাসের সুবিধা ও অসুবিধা

এলাকার জলবায়ু, মাটি ও চাহিদা বিবেচনা করে লাভজনক ফসল নির্বাচনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। প্রচলিত ফসল বিন্যাস অবলম্বনে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব হয় না।

ফসল বিন্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।

এলাকার জলবায়ু ও মৃত্তিকা দ্বারা অভিযোজিত ফসলসমূহের মধ্যে হতে কয়েকটি ফসল বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এর জন্য আর্থ-সামাজিক উপাদানসমূহই মূলত দায়ী। যার কারণে ফসল বিন্যাসে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

কোন এলাকার জন্য অধিকসংখ্যক লাভজনক ফসল নির্বাচনের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে উচ্চ ফলনশীল আলোক নিরপেক্ষ জাত উদ্ভাবন, আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর, ঋণসুবিধা, বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, গুদামঘর তৈরি, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। যা মানুষের সুষম খাবার নিশ্চিত করে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে।

জমির প্রকার বা ধারা অনুসারে আমাদের বাংলাদেশের ফসল বিন্যাসের উদাহরণ দেয়া হলো-

জমির ধরনফসল বিন্যাসের প্রকৃতি
উচু জমি১. বোরো- আমন-পতিত ২. আলু-বোরো-আমন ৩. ডাল-পাট-পতিত ৪. গম-কাউন-আমন ৫. টমেটো-আউশ-সবজি
মাঝারি জমি১. আলু-বোরো-ডাল ২. গম-আমন-ডাল ৩. সরিষা-বোরো-আমন ৪. বোরো-আমন-সরিষা ৫. টমেটো-আউশ-সবজি
নিচু জমি১. আলু-বোরো-বোনা আমন ২. বোরো-আমন-পতিত ৩. কাউন-আমন-পতিত ৪. গম-বোরো-আমন ৫. পাট-আমন-পতিত

ফসল উৎপাদনে কোন এলাকায় অনুসরণকৃত বাৎসরিক ধারাকে ফসল বিন্যাস বলা হয়ে থাকে। ফসল বিন্যাস নির্দিষ্ট এলাকার জলবায়ু, মৃত্তিকা ও আর্থসামাজিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।

উপরোক্ত আলোচনাটি থেকে আমরা ফসল বিন্যাস কাকে বলে, ফসল বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ এবং ফসল বিন্যাসের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো জানলাম। ফসল বিন্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে নতুন ফসল জাত উদ্ভাবন, এলাকাভিত্তিক কৃষি সমস্যা দূরীকরণ, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন আবশ্যক।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জমি চাষের বিবেচ্য বিষয় কয়টি ও কি কি

জমি চাষের বিবেচ্য বিষয় কয়টি ও কি কি?

আলোচ্য বিষয়: (১) জমি চাষের বিবেচ্য বিষয় কয়টি ও কি কি? (২) জমি প্রস্তুতি বলতে কি বুঝায়? এর উদ্দেশ্য ... Read More
ফলের নাম ও ছবি

৩০+ ফলের নাম ও ছবি

আলোচ্য বিষয়: নিচে ৩৪টি ফলের নাম ও ছবি উপস্থাপন করা হলো- (১) আম (২) কাঁঠাল (৩) কলা (৪) পেঁপে (৫) আনারস (৬) পেয়ারা (৭) কুল (৮) লিচু (৯) নারিকেল (১০) কমলা (১১) মাল্টা (১২) লেবু (১৩) কাগজীলেবু (১৪) মিষ্টি লেবু (১৫) বাতাবিলেবু (১৬) সাতকরা (১৭) আমড়া (১৮) জামরুল (১৮) সফেদা (১৯) কামরাঙ্গা (২০) তৈকর (২১) লটকন (২২) আমলকি (২৩) আঁশফল (২৪) রাম্বুতান (২৫) স্ট্রবেরি (২৬) বিলাতিগাব (২৭) কদবেল (২৮) বেল (২৯) জলপাই (৩০) ড্রাগন ফল (৩১) নাশপাতি (৩২) প্যাশন ফল (৩৩) তেঁতুল (৩৪) এ্যাভাকেডো ... Read More
ছোলা চাষ পদ্ধতি

ছোলা চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) ছোলা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য (২) ছোলা চাষে পোকা ও রোদ দমন ব্যবস্থাপনা ... Read More
কমলা চাষ পদ্ধতি, কোন মাটিতে কমলা ভালো হয়, কমলা গাছের পরিচর্যা

কমলা চাষ পদ্ধতি, কোন মাটিতে কমলা ভালো হয়? কমলা গাছের পরিচর্যা

আলোচ্য বিষয়: নিম্নে কমলা চাষ পদ্ধতি সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপনা করা হলো- (১) কলমার জাত (২) কমলার চাষের উপযোগী জলবায়ু ও কোন মাটিতে কমলা ভালো হয়? (৩) কমলার বংশবিস্তার (৪) কমলা চাষে জমি তৈরি (৫) কমলা চাষে সার ব্যবস্থাপনা (৬) কমলা গাছের চারা রোপন (৭) কমলা গাছের পরিচর্যা (৮) কমলা গাছের রোগ ও পোকামাকড় দমন (৯) কমলা সংগ্রহ (১০) কমলার ফলন ... Read More
আলুর চিপস ও ফ্লেঞ্চ ফ্রাই তৈরি করার পদ্ধতি

আলুর চিপস ও ফ্লেঞ্চ ফ্রাই তৈরি করার পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: নিম্নেআলুর চিপস ও ফ্লেঞ্চ ফ্রাই তৈরি করার পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো- (১) আলুর চিপস তৈরির রেসিপি ও চিপস তৈরির পদ্ধতি (২) আলুর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তৈরির রেসিপি ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তৈরির পদ্ধতি ... Read More
জামরুল ফল চাষের পদ্ধতি

জামরুল ফল চাষের পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) জামরুল ফলের জাত পরিচিতি (২) জামরুল ফল চাষের পদ্ধতি ... Read More
ফটোপিরিয়ডিজম কি, কাকে বলে, দিবা দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ

ফটোপিরিয়ডিজম কি/কাকে বলে? দিবা দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ

আলোচ্য বিষয়: (১) ফটোপিরিয়ডিজম কি/কাকে বলে? (২) দিবা দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ (৩) ফটোপিরিয়ডিজমের তাৎপর্য (৪) বিভিন্ন ধরনের দিবা দৈর্ঘ্য নিরপেক্ষ ফসল ও ফসলের জাত চিহ্নতকরণ ... Read More
বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি (২) বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি ... Read More
গাঁদা ফুলের চাষ পদ্ধতি

গাঁদা ফুলের চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) গাঁদা ফুলের বৈশিষ্ট্য ও জাত পরিচিতি (২) গাঁদা ফুলের চাষ পদ্ধতি ... Read More
কাঁঠাল চাষে সেচ পদ্ধতি

কাঁঠাল চাষে সেচ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: নিম্নে কাঁঠাল চাষে সেচ পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো- ... Read More