ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফসল বীজ ও বংশবিস্তারক উপকরণ।
এদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন বছরের পর বছর ফসল উৎপাদন করতে পারি, তেমনি একটি দেশে নতুন ফসল আত্তীকরণ ও সংযোজন করতে পারি, একটি ফসলের জীবতাত্ত্বিক গুণাগুণ ধরে রাখতে পারি এবং নানা জীব কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে উন্নততর করে তুলতে পারি।
(১) বীজ কাকে বলে?
বীজ উদ্ভিদের বংশবিস্তারের প্রধান মাধ্যম। সাধারণভাবে উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য যে অংশ ব্যবহার করা হয় তাকে বীজ বলে।
(২) বীজ কী?
বীজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে আমরা বীজকে দুইভাবে বুঝতে পারি। যথা-
উদ্ভিদতত্ত্ব অনুসারে, উদ্ভিদের নিষিক্ত ও পরিপক্ক ডিম্বককে বীজ বলে। এ ধরনের বীজকে ফসল বীজ বা প্রকৃত বীজ বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজও বলে।
কৃষিতত্ত্ব অনুসারে উদ্ভিদের যে কোনো অংশ (মূল, পাতা, কাণ্ড, কুঁড়ি, শাখা) যা উপযুক্ত পরিবেশে একই জাতের নতুন উদ্ভিদের জন্ম দিতে পারে, তাকে বংশবিস্তারক উপকরণ বলে। এ ধরনের উপকরণকে কৃষিতাত্ত্বিক বীজ বা অঙ্গজ বীজও বলা হয়।
ফসল উৎপাদনের জন্য যে সব ধাপ অতিক্রম করা হয় বীজ উৎপাদনের জন্যও সেভাবেই অগ্রসর হতে হবে।
পার্থক্য হলো এই যে, বিভিন্ন ফসলের বীজ যেমন- ধান, পাট, গম, মুলা, মরিচ ইত্যাদি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ধাপসমূহের বিশেষ যত্নবান হতে হয়:
ক) বীজ জমি নির্বাচন
বীজ উৎপাদনের জন্য উর্বর জমি নির্বাচন করা উচিত।
জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত ও আলোবাতাসযুক্ত হতে হবে।
নির্বাচিত জমিতে পূর্ববর্তী বছরে একই জাতের বীজের চাষ না হয়ে থাকলে আরও ভালো।
নির্বাচিত জমিতে অন্তত ২% জৈব পদার্থ থাকা উচিত।
খ) বীজ জমি পৃথকীকরণ
বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচিত জমি ও পার্শ্ববর্তী একই ফসলের জমির মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধান থাকতে হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত শস্য বীজের সাথে যেন অন্য জাতের বীজের সংমিশ্রণ না ঘটে।
গ) বীজ সংগ্রহ
বীজ সংগ্রহ বীজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বীজ উৎপাদনের জন্য অবশ্যই প্রত্যায়িত বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
বীজ সংগ্রহের সময় নিম্নোক্ত তথ্য জেনে নিতে হবে-
জাতের নাম;
বীজ উৎপাদনকারীর নাম ও নম্বর;
অন্য জাতের বীজের শতকরা হার;
বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা;
বীজের আর্দ্রতা।
উল্লিখিত তথ্যগুলো একটি গ্যারান্টি পত্রে ট্যাগ লিখে বীজের বস্তায় বা প্যাকেটে রাখা হয়।
ঘ) বীজের হার নির্ধারণ
বীজের বিশুদ্ধতা, সজীবতা, অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা, আকার, বপনের সময়, মাটির উর্বরতা শক্তি এসব বিবেচনা করে হেক্টর প্রতি বীজের হার নির্ধারণ করা হয়।
ঙ) নির্বাচিত জমি প্রস্তুতকরণ
এক এক জাতের বীজের জন্য জমির প্রস্তুতি এক এক রকম হয়ে থাকে। যেমন, রোপা ধানের বীজ উৎপাদন করতে জমি ভালোভাবে কর্দমাক্ত করে চাষ করতে হবে।
আবার গমের বেলায় জমি শুকনো অবস্থায় ৪-৫ বার চাষ করে পরিপাটি করতে হবে।
সার প্রয়োগের মাত্রাও এক এক বীজের জন্য এক এক রকম হবে।
কোন বীজ কত গভীরতায় বপন করতে হবে তা বীজের আকার, আর্দ্রতা ও মাটির উপর নির্ভর করে।
ছ) রগিং বা বাছাইকরণ
বীজ বপনের সময় যতই বিশুদ্ধ বীজ ব্যবহার করা হোক না কেন জমিতে কিছু কিছু অন্য জাতের উদ্ভিদ ও আগাছা দেখা যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ তুলে ফেলতে হবে।
তিন পর্যায়ে রগিং বা বাছাই করা হয়।
ফুল আসার আগে
ফুল আসার সময়
পরিপক্ক পর্যায়ে
জ) পরিচর্যা
বীজের উৎপাদনের জন্য খুব বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। নিচে কয়েকটি পরিচর্যার ধরন উল্লেখ করা হলো-
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা
জৈব সার প্রয়োগ
প্রয়োজনমতো সেচ দেওয়া
বৃষ্টির পানি বা সেচের পানি জমলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা
আগাছা পরিষ্কার করা
রোগ ও পোকা দমন করা
সারের উপরি প্রয়োগ করা
ঝ) বীজ সংগ্রহ
বীজ পরিপক্ক হওয়ার পর পরই কাটতে হবে। তারপর মাড়াই করে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে।
(৪) বংশবিস্তারক উপকরণ উৎপাদনের ধাপসমূহ
বাংলাদেশে ফুল ও ফলের চারা অঙ্গজ পদ্ধতিতে উৎপাদনের প্রচলন খুব বেশি। কারণ এসব গাছের বংশবিস্তার প্রকৃত বীজের মাধ্যমে হলে ফুল ফল পেতে সময় বেশি লাগে ও মাতৃগাছের বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। এ ছাড়া অনেক ফসলের প্রকৃত বীজ দ্বারা বংশবিস্তার ঘটানোও সম্ভব নয়।
অঙ্গজ পদ্ধতিতে মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল, শাখা প্রভৃতি দ্বারা দ্রুত ও অল্প সময়ে চারা উৎপাদন সম্ভব। তাই এগুলো হলো ফসলের বংশবিস্তারক উপকরণ।
কিছু কিছু ফসল যেমন- আনারস, কলা, আলু, আদা, হলুদ প্রভৃতির বংশবিস্তারক উপাদান সরাসরি রোপণ করা যায়।
আবার কিছু ফসল যেমন- আম, লেবু, লিচু, জামরুল, গোলাপ ইত্যাদির বংশবিস্তারক উপাদান বিভিন্ন ধরনের কলম তৈরির মাধ্যমে প্রস্তুত করে ব্যবহার করা হয়।
নির্বাচিত জমি অন্যান্য ফসল যেমন- মরিচ, টমেটো, তামাক ইত্যাদি সোলানেসি গোত্রভুক্ত ক্ষেত থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে থাকতে হয়।
৫-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরা করে আগাছা মুক্ত করতে হবে।
চাষ অন্তত ১৫ সেমি গভীর হতে হবে।
মাটি বেশি শুকনো হলে প্লাবন সেচ দিয়ে মাটিতে ‘জো’ আসার পর আলু লাগাতে হবে।
খ) বীজ শোধন
হিমাগারে রাখার আগে বীজ শোধন না হয়ে থাকলে অঙ্কুর গজানোর পূর্বে বীজ আলু বরিক এসিড দিয়ে শোধন করে নিতে হবে (১ লি. পানি + ৩০ গ্রাম বরিক পাউডার মিশিয়ে বীজ আলু ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে পরে ছায়ায় শুকাতে হবে)।
গ) বীজ প্রস্তুতি
বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আস্ত আলু বপন করা ভালো, কারণ আস্ত বীজ রোপনের পর এগুলোর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম।
আলু কেটে লাগালে প্রতি কর্তিত অংশে অন্তত ২ টি চোখ অবশ্যই রাখতে হবে।
আলু কাটার সময় বারবার সাবান পানি দ্বারা ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগ জীবাণু এক বীজ থেকে অন্য বীজে না ছড়ায়।
বীজ আলু আড়াআড়িভাবে না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটতে হবে।
ঘ) মাটিতে ঔষধ প্রয়োগ
ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য শেষ চাষের পূর্বে প্রতি শতাংশ জমিতে ৮০ গ্রাম স্টেবল ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরোপিক্সিন মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া উত্তম।
ঙ) সার প্রয়োগ
দুটি কারণে আলুতে সুষম সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
প্রথমত সুষম সার প্রয়োগ করলে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত বীজ আলুর গুণগত মান ভালো হয়।
দ্বিতীয়ত গাছে কোনো খাদ্যোৎপাদনের অভাবজনিত লক্ষণ সৃষ্টি হলে ভাইরাস রোগের উপস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে আলু চাষের জন্য নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু গোবর, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, জিঙ্ক সালফেট, বরিক পাউডার জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়।
বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়ার সময় প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে।
আলু তোলার পর কোনো অবস্থাতেই ক্ষেতে স্তূপাকারে রাখা যাবে না, কারণ ক্ষেতে আলু খোলা রাখলে তা বিভিন্ন প্রকার রোগ ও পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে (যেমন-সুতলি পোকা ডিম পাড়তে পারে)।
দ) আলু সংরক্ষণ
আলু উত্তোলনের পর বাড়িতে এনে সাথে সাথে কাটা, দাগি ও পচা আলু আলাদা করে বেছে ফেলতে হবে। তারপর ৭-১০ দিন মেঝেতে আলু বিছিয়ে রাখতে হবে।
অতঃপর আবারও দাগি ও পচা আলু বেছে বাদ দিয়ে ভালো আলু বস্তায় ভরে হিমাগারে পাঠাতে হবে।
এছাড়া বীজ আলু উৎপাদনের আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে। যেমন-
টিস্যু কালচার পদ্ধতি
স্প্রাউট ও টপ শুট কাটিং পদ্ধতি
বিনাচাষে বীজ আলু উৎপাদন
আলুর প্রকৃত বীজ উৎপাদন।
(৬) ফসল বীজের গুরুত্ব
ফসল উৎপাদনে ফসল বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে সব ফসল কেবল বীজের মাধ্যমেই ফলানো সম্ভব সে ক্ষেত্রে উদ্ভিদের বংশরক্ষার্থে ফসল বীজের বিকল্প নেই। এছাড়াও-
ফসল বীজ ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপকরণ।
ফসল বীজ মানুষসহ পশু পাখির খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
বিশুদ্ধ ফসল বীজ রোগ, পোকামাকড় ও আগাছা বিস্তার রোধ করে।
ফসল বীজের মাধ্যমে উন্নত জাতের ফসল উৎপাদন সম্ভব।
ফসল বীজের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশধারা টিকে থাকে।
কোনো কোনো বীজ ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ফসল বীজ অনেক শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
(৭) বংশবিস্তারক উপকরণের গুরুত্ব
অধিকাংশ ফসলের বংশবিস্তার বীজ দ্বারা সম্ভব হয় না বা সম্ভব হলেও দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে ফলন পাওয়া যায়। কাজেই জনবহুল কোনো দেশের জন্য ফসল দ্রুত পাওয়ার জন্য বংশবিস্তারক উপকরণ তথা কৃষিতাত্ত্বিক বীজের বিকল্প নেই।
এতে উদ্ভিদের মূল, কাণ্ড, শাখা, পাতা, শিকড়, কুঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে বংশবিস্তার করা হয় বলে মাতৃগুণাগুণ বজায় থাকে। একই গাছে একাধিক জাতের সংযোজন ঘটানো যায়।
আলোচ্য বিষয়: (১) লালশাকের জাতের নাম ও পরিচিতি (২) লালশাক চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত বর্ণনা (৩) ছাদ বাগানে শাক চাষ পদ্ধতি (৪) রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা ... Read More
প্রিয় খামারি বন্ধুরা, আপনারা অনেকই জানতে চান ভুট্টার উচ্চ ফলনশীল জাত কোনটি? তারই প্রেক্ষিতে আমরা অনুষন্ধান করে আপনাদের জন্য ভুট্টার উচ্চ ফলনশীল জাত এর তলিকা প্রস্তুত করেছি। ভুট্টার উচ্চ ফলনশীল জাতের নাম ও ফলনের পরিমাণ, তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে সেরা ভুট্টার উচ্চ ফলনশীল জাত কোনটি? কোন প্রতিষ্ঠান বা কম্পানির ভুট্টার উচ্চ ফলনশীল জাত কোনটি? ইত্যাদি বিষয়গুলো সাজিয়েগুছিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করিআলোচনাটি আপনার উপকারে আসবে। আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন। চলুন শুরা করা যাক। ... Read More
আলোচ্য বিষয়: (১) গ্লাডিওলাস ফুলের বৈশিষ্ট্য ও জাত পরিচিতি (২) গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ পদ্ধতি (৩) গ্লাডিওলাস চাষে রোগ দমন ব্যবস্থা (৪) গ্লাডিওলাস চাষে পোকা দমন ব্যবস্থা ... Read More
