সূফিবাদ কি? সুফিবাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও প্রয়োজনীয়তা

informationbangla.com default featured image compressed

আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হলো ইসলাম।ইসলামের অর্থ আনুগত্য। আল্লাহতালা মানব জীবনের সকল কর্মকান্ড সমূহ পরিচালনা করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে এ জীবনবিধান পেশ করেছেন। ইসলাম ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজি, রাষ্ট্রীয, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে । ইসলাম মানুষের দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করে। একটি হলো বাহ্যিক বা বস্তুগত দিক, আরেকটি হলো অভ্যন্তরীণ বা আধ্যাত্মিক দিক। আর অভ্যন্তরীণ দিকই হলো তাসাউফ বা সুফিবাদ। চলুন তাহলে সুফিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই-

মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত শুধু তার দেহের জন্য করে নি বরং তাঁর একটি বাতিনী দিক আছে যা হলো আত্মা। আত্মার শান্তির জন্য মানবতা যুগে যুগে জড়বাদ,বস্তুবাদের আবর্তে ঘুরছে কিন্তু প্রকৃত শান্তি তারা খুঁজে পায় নাই।

তাই কবি শেখ সাদী (রঃ) বলেন, ‘এই সমুদ্রে হজার কিশতী ডুবে গেছে, কিন্তু একটিও ভেসে উঠে নদীর তীরে পৌঁছেনি।’

জড়বাদ মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে, বুদ্ধিবাদ তা পূর্ণ করতে পারে নি। আর তার শূন্যতা পূরণ করেছে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা। আর এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানই হলো সুফিবাদ। মানুষের জীবন আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে গঠিত। যে জ্ঞানের সাহায্যে আত্মা পরিশুদ্ধ করা যায় তাকে সুফিবাদ বা তাসাউফ বলে।

(১) তাসাউফ বা সুফিবাদের পরিচয়

সুফিবাদের পরিচয় দু’ভাবে প্রদান করা যায়। যথা-

  1. আভিধানিক সংজ্ঞা
  2. পারিভাষিক সংজ্ঞা

ক) আভিধানিক সংজ্ঞা

সুফি কোন শব্দ থেকে এসেছে সে ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতদের ভিতর বেশ কয়েকটি মতবাদ পাওয়া যায়। সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

প্রথম মতামত: ইবনে খালদুন, ড.এ.ই.আফিফী,আল-কালবাদী,আর রুদবারী,নিকলস ইত্যাদি পন্ডিতগণের মতে, সুফি শব্দটি সূূূূফুন হতে নির্গত যার অর্থ হলো পশম। পশমি বস্ত্র সরলতা ও আরম্ভহীনতার প্রতীক। হযরত মুহাম্মদ (সাাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ বিলাসী জীবনযাপনের পরিবর্তে সাদাসিধে পোশাক পরতেন পরবর্তীতে সুফিগণ সাদাসিধে জীবন যাপনের জন্য এই পশমি পোশাক পরিধান করতেন তাই তাদেরকে সুফি বলা হয়।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

দ্বিতীয় মতামত: কারো মতে, সুফি কথাটি সফফুন হতে নির্গত যার অর্থ হলো কাতার, শ্রেণী, লাইন ইত্যাদি। যেহেতু, মর্যাদার দিক থেকে সে প্রথম শ্রেণীর লোক, এজন্য তাকে সুফি বলা হয়।

তৃতীয় মতামত: আলী হাজাবীরি, মোল্লা জামী (রঃ) মতে, সুফি কথাটি সাফা হতে নির্গত যার অর্থ হলো পবিত্রতা, আত্মশুদ্ধি ও স্বচ্ছলতা । যারা আত্মার পবিত্রকরণ সাধনায় নিয়োজিত থাকেন তাদেরকে সুুুফি বলা হয়।

চতুর্থ মতামত: কিছু পাশ্চাত্যের পন্ডিত বলেছেন যে, সুফি কথাটি সোফিয়া বা সোফিস্ট কথা হতে নির্গত হয়েছে। যার অর্থ জ্ঞান। কিছু মানুষ আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী বলে তাদেরকে সুফি বলা হয়। আর এ শাস্ত্রকে তাসাউফ বলা হয়।

তবে শেষোক্ত মতামত একেবারে অগ্রহণযোগ্য। কারণ বিদেশী কোন শব্দ হতে ইসলামের কোন একটি বিষয় নির্গত হবে তা হতে পারে না। অন্যদিকে প্রথম তিনটি মতামতের ভিত্তিতে যে সুফি শব্দটি এসেছে তাও অনেকে মানতে নারাজ। এ ব্যাপারে মোঃ আব্দুল মালেক ও মোঃ আব্দুল লতিফ স্যারের “ইসলামের সুফি দর্শন” নামক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, সুফি কথাটি যে সুফূন হতে নির্গত অগ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর দ্বারা সুফিদের কেবল পোশাক-পরিচ্ছদ ও অবয়বের কথা বলা হয়েছে।যেহেতু সুফিবাদ মানুষের বাতিনী দিকের পরিচায়ক তাই এই বাহ্যিক দিকের নির্দেশক পশম হতে সুফির উৎপত্তি হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত নয়।

আবার সাফা হতে সুফি কথাটি এসেছে তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এটি হলো সুফিদের জীবন সাধনার একটি নির্দেশক মাত্র। আবার সফফুন হতে সুফি এসেছে, এ কথাও বিশ্বাস করা যায় না, কারণ তারা একটি কাল্পনিক ধারণা মাত্র। একমাত্র আহলে সুফফা শব্দে সুফিতত্ত্বের ও সুফি জীবনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক পরিস্ফুট হয়ে উঠে। তারাই সর্বদা পশমী পোশাক পরিধান করতেন এবং সর্বদা আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকতেন। তারা আল্লাহর সামনে চাদরাবৃত। তারাই নবী করিম (সা:) এর সাহচর্যে থেকে সর্বদা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কাজেই আহলে সুফফা হতে যে সুফি কথাটির উদ্ভব ঘটেছে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

শাব্দিক দিক থেকে তাসাউফ শব্দটির নিম্নোক্ত অর্থ হতে পারে-

  • সূফীতত্ত্ব
  • আধ্যাত্মিকতা
  • রহস্য বিজ্ঞান
  • এলমে মারেফাত
  • পরিচয় বিজ্ঞান
  • পবিত্রতা
  • সারিবদ্ধ
  • বিন্যাস
  • খাঁটি
  • Wisdom
  • Wool
  • Purity ইত্যাদি।

খ) পারিভাষিক সংজ্ঞা

ইমাম শামী (র:) বলেন, ‘সুফিবাদ হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সব গুণাবলীর প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্থা ও অসৎ গুণাবলীর প্রকারভেদ ও রক্ষার উপায় জানা যায়।’

জুনায়েদ বাগদাদী (র:) এর মতে, ‘আত্মিক পবিত্রতা অর্জন আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকে প্রভাবমুক্ত আমার নাম হলো সুফিবাদ।’

যূননূন মিসরী (র:) বলেন, ‘মহান আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত সকল কিছু বর্জন করায় তাসাউফ।’

আবুল হোসাইন আল নূরী (র:) বলেন, ‘ইন্দ্রিয়জ আত্মার কুপ্রবৃত্তির বিসর্জনই তাসাউফ।’

হাসান বসরী (র:) এর মতে , ‘পার্থিব জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে পরিহার করে পরলৌকিক সুখ-শান্তিকে প্রাধান্য দেওয়ায় সুফিবাদ।’

ইমাম গাজ্জালী (র:) বলেন, ‘তাসাউফ এমন একটি বিদ্যা যা মানুষকে পশু হতে উন্নত করে ,মানুষত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।’

বায়েজিদ বোস্তামী (র:) বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকা ও আল্লাহকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে পার্থিব দুঃখ-কষ্ট বরণ করার নাম হল সুফিবাদ।’

শাইখুল ইসলাম জাকারিয়া (র:) বলেন, ‘তাসাওফ মানুষের আত্মার বিশোধনের শিক্ষাদান করে। আর নৈতিক জীবনকে উন্নত করে এবং স্থায়ী নেয়ামতের অধিকারী করার উদ্দেশ্যে মানুষের ভেতরের ও বাইরের জীবনকে গড়ে তোলে।এর বিষয়বস্তু হলো আত্মার পবিত্রতা ও লক্ষ্য হলো চিরন্তন সুখ শান্তি অর্জন।’

আবু সাহল সালুকীর মতে, ‘আপত্তিকর ও নিন্দনীয় সকল বিষয় থেকে দূরে থাকাই সুফিবাদ।’

আবু আলী কাজিনীর মতে, ‘সুফিবাদ হল মনোরম সুন্দর আচরণ।’

Al-qushairy said, ‘Sufism is the sence of purity,purity of enter and outer life.’

আবু মুহাম্মদ আয-যারিনী বলেছেন, ‘Sufism is the building out of good habits and freeing of heart from all evil desires.’

সর্বোপরি মনের কালিমা জটিলতা, কুটিলতা, লোভ-লালসা ,হিংসা-বিদ্বেষ ,পরশ্রীকাতরতা মোহ প্রভৃতি দূর করে স্রষ্টার পরমসত্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তার প্রেম ও সান্নিধ্য লাভের জ্ঞান ও পথকে তাসাউফ বলে।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

(২) সুফিবাদের উৎপত্তিমূলক মতবাদ

সুফি চিন্তাধারায় উৎপত্তি সম্পর্কে চারটি মতবাদ রয়েছে। যথা-

  1. বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব
  2. খ্রিস্টান ও নিও-প্লেটানিক প্রভাব
  3. পারসিক প্রভাব
  4. কুরআন হাদিসের প্রভাব

ক) বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব

পাশ্চাত্যের কোন কোন পন্ডিতের ধারণা, মুসলিম চিন্তাধারায় সুফিতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে বেদান্ত ও বৌদ্ধ ধর্মের সংস্পর্শে এসে। এইচ মার্টিন, গোল্ড যিহার এই মতামতের প্রবক্তা, সমর্থক ও পরিপোষক। দর্শনের ইতিহাসে এটি “The theory of vrdatic or Budhistic influence” নামে পরিচিত। মুসলমানরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে এরপর থেকে ভারতীয় সন্ন্যাসী ও বেদান্ত বৌদ্ধদের প্রভাবে প্রভান্বিত হয়ে মুসলমানগণ কঠোর সংযম ও কৃচ্ছতা সাধনের স্পৃহা জাগিয়ে তুলে। আর সে থেকে মুসলমানদের ভিতর সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে। পারতপক্ষে, এ ধরনের মতামত ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সঠিক নয়। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা আসার অনেক আগে থেকে সুফিবাদ কথাটির উদ্ভব ঘটেছিল।

হাসান বসরী, যুন্নুন মিসরী, আবুল হাশিম কূফী, ইব্রাহিম বিন আদহাম রাবিয়া বসরী প্রমুখ সুফিদের আবির্ভাব ও সাধনা প্রমাণ করে যে, সুফিবাদ ভারতীয় আমদানি নয়, ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার ফলে সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ জাগতিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আর ধ্যান সাধনার জন্য নির্জন জায়গা বেছে নিয়েছে, অন্যদিকে মুসলিম সুফিসাধকগণ আল্লাহপাকের ধ্যান করার সাথে সাথে সংসারও করে থাকেন। আবার বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণ সত্তায় আত্মবিলাপ শেষ আর মুসলিম সূফীগণ ফনাকে শেষ স্তর বলে মনে করে না বরং তারা বাকাবিল্লাহকে সুফি পথ পরিক্রমার সর্বশেষ স্তর মনে করে থাকে। সুতরাং বৌদ্ধ ও বেদান্ত হতে সুফিবাদের উৎপত্তি হয়েছে এ ধরনের মতবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

অধ্যাপক নিকলসন বলেন, ‘The main currents of Indian influence upon Islamic civilization belong to a latter epoeh.’

খ) খ্রিস্টান ও নিও-প্লেটানিক প্রভাব

অধ্যাপক নিকলসন ও ভনক্রেমার এ মতবাদের প্রবক্তা। এ মতবাদ “The theory of christian or neo-platonic influence” নামে খ্যাত। অধ্যাপক নিকলসন জোর দিয়ে বলেছেন ইসলামে সুফি চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটেছে খ্রিস্টান ও নিও প্লেটোনিক চিন্তাধারা থেকে। কারণ মুসলমানগণ নিও প্লেটোনিক চিন্তাবিদ খ্রিস্টান মিশনারীদের সংস্পর্শে আসার ফলেই ইসলামে সুফি চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

এসব ভাববাদী খ্রিস্টান চিন্তাশীল সন্ন্যাসীরা হিজরী সালের কয়েক শতকের মধ্যেই খ্রিস্টান মতবাদ প্রচার কল্পে সিরিয়া বা আরবের মধ্যপ্রাচ্যে সর্বত্রই ঘুরে বেড়ানো এবং এদের সংস্পর্শে আসার ফলেই মুসলমানদের মধ্যে সুফিবাদ জন্ম লাভ করে। খ্রিষ্ট্রীয় ও নিও-প্লেটোনিক মতবাদ হতে যে সুফিবাদের উদ্ভব ঘটেছে, এ ধরনের কথা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক। মুসলিম সুফি সাধকগণ খ্রিষ্টীয় সন্নাসীদের ন্যায় সংসার বিরাগী নায়। আর তাছাড়া মহানবী (সাঃ),সাহাবা ও তাবিঈদের সময় হতে এধরনের আধ্যাত্মিক সাধনায় মুসলমানরা নিয়োজিত ছিল।

গ) পারসিক প্রভাব

ঐতিহাসিক ব্রাউনি আর তার কিছু অনুসারীরা বলেছেন যে ,সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটেছে পারসিক প্রভাব হতে। তারা এ যুক্তি সকলের সামনে তুলে ধরেছে যে পারসিক জাতি ছিল এক অহংকারী ও দম্ভ জাতি। কিন্তু তাদের উপর যখন আরবরা জয় করল তখন হতে তাদের ভিতর এক ধরনের হতাশা কাজ করতে শুরু করল। সেখান থেকে তারা আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে এক ভিন্ন চিন্তাধারা আবিষ্কার করে আর সেখান থেকে সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটে। আর তারই ধারাবাহিকতায় পারস্যে অনেক দার্শনিকের আবির্ভাব হয়।

এ মতবাদ ঐতিহাসিকভাবে অসত্য ও ভিত্তিহীন। ইতিহাসের সাহায্যে প্রমাণ করা যায় না, সুফিবাদ পারস্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী ,ইবনুল ফরিদ আরাবী ভাষাভাষী ছিলেন। সুফিবাদ তার নিজস্ব সক্রিয়তায় অমরতা লাভ করেছেন।

ঘ) কুরআন-হাদিসের প্রভাব

সকল মুসলিম চিন্তাবিদ এবং অধিকাংশ গবেষকের মতে, আল-কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা থেকে সুফিবাদের উৎপত্তি হয়েছে। কুরআন মাজিদে এমন অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে মহানবী (স:) এর এমন অসংখ্য উদ্বৃতি রয়েছে যা সুফিবাদের ভাব ও অর্থ বহন করে।প্রকৃতপক্ষে এ সকল সূরা ও আয়াত নাযিল হওয়ার পরেই ইসলামে সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটে। নিম্নে কুরআনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হল-

وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

অর্থ: পূর্ব ও পশ্চিম আল্লারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।

(সূরা বাকারা: ১১৫)

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

অর্থ: সুতরাং, তোমরা আমাকে স্মরণ করো ,আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সূরা বাকারা: ১৫২)

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ

অর্থ: এবং যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গী। (সূরা আনকাবূত: ৬৯)

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

অর্থ: অথচ তাদেরকে এ ছাড়া অন্য কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁর প্রতি একনিষ্ঠভাবে দ্বীনকে খাঁটি রাখে, একনিষ্ঠ হয়ে এবং নামাজ কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে। আর এটাই সঠিক দ্বীন। (সূরা বাইয়েনাহ্: ৫)

فَإِذا سَوَّيتُهُ وَنَفَختُ فيهِ مِن روحى فَقَعوا لَهُ سٰجِدينَ

অর্থ: যখন আমি সে মনুষকে সুঠাম করব এবং সে দেহে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি অবনত হও। (সূরা হিজর: ২৯)

হাদিস-১: যে ব্যাক্তির মধ্যে কোন প্রশ্ন নেই, সে বিশ্বাসী নয়।

হাদিস-২: যে ব্যক্তি নিজেকে চিনল, সে আল্লাহকে চিনল।

(৩) সূফীবাদের ক্রমবিকাশ

হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে বা তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে সুফিবাদের উদ্ভব হয় বলে সাধারণভাবে অনুমান হয়ে থাকে । এই ভুল অনুমানের জন্য কেউ কেউ সুফিবাদকে গ্রীক দর্শন এর সাথে মিলিয়ে ফেলেন। নিম্নে এর ক্রমবিকাশ দ্বারা আলোচনা করা হলো-

পৃথিবী সৃষ্টির লগ্ন থেকেঃ

পৃথিবীতে হযরত আদম (আ:) এর আগমনকালীন সময়ে সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটে। প্রায় পৌনে শতাব্দি অনুশোচনায় দগ্ধীভূত হযরত আদম (আ:) মূলত সুফিবাদের সাধনাতেই লিপ্ত ছিলেন। বংশপরম্পরায় হযরত হাবিল, হযরত শীষ, হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) ইত্যাদি নবীগণের মধ্যে সুফিবাদের বিকাশ লাভ করে।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

রাসূল (সাঃ) এর যুগে সুফিবাদঃ

আল-কুরআনের আধ্যাত্মিকতার আয়াতসমূহ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে সুফিবাদের সূত্রপাত ঘটে।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

“তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর তিনি অন্তরসমূহে বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত।” (সূরা হাদিদ: ৬)

“আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন।” (সূরা হাদিদ: ৪)

“আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” (সূরা ক্বাফ: ১৬)

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেও সুফিসুলভ ভাব ব্যক্ত করেছেন এবং মাঝে মাঝে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। পৃথিবীর হাজারো কাজের মাঝেও তিনি আল্লাহর দ্বীনে একান্ত মনোনিবেশ করতেন। এসময়ে সূফীবাদের সাধনার সকল প্রশিক্ষণ তিনি প্রদান করেছিলেন।

সাহাবী যুগে সুফিবাদঃ

মহানবী (সাঃ) এর একদল সাহাবী ইসলাম গ্রহণের পর হতেই সূফির অনুশীলন করছিল। যারা মসজিদে নববীর এক কোণে ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। যাদেরকে আহলে সুফফা বলা হত।মহানবী (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের চার খলিফা সহজ, সরল জীবনযাপন ও আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন।

সুফিবাদের শাস্ত্রীয় বিকাশঃ

সুফিবাদের প্রথাসিদ্ধ শাস্ত্রীয় ও স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু হয় সাহাবীগণের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর। হযরত হাসান বসরী সুফিবাদের প্রথম সুফি হিসেবে খ্যাত।তার জ্ঞান তত্ত্বের আলোকে সুফি সাধকগণ সুফিবাদের ক্রমবিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও সর্বপ্রথম সূফী হিসেবে যার নাম স্বীকৃতি দেওয়া হয় সে হলো হাশিম কূফি। কেউ কেউ আবার জাবির ইবন হাইয়্যানকে প্রথম সূফী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।

সূফিবাদের দ্বিতীয় স্তরঃ

সূফিবাদের দ্বিতীয় স্তর শুরু হয় হযরত যুন্নুন মিসরির মাধ্যমে। তিনি সুফিবাদকে মতবাদ হিসেবে রূপদান করেছেন।তার মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাগদাদী তার মতবাদ সংকলন ও সুসংহত করেন।জুনায়েদ বাগদাদীর শিষ্য আল শিবলি-এর আরো পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধন করেন।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

সর্বখোদাবাদ প্রবর্তনঃ

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী ও আল হুসাইন ইবন মনসুর হাল্লাজ সুফিবাদকে সর্বখোদাবাদের দিকে নিয়ে যায়। বায়েজিদ বোস্তামি সুফিবাদের মধ্যে ফানা মতবাদ প্রবর্তন করেন। তার মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তি নিজেকে মহান আল্লাহর মধ্যে সমাহিত করতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সে পরমসত্তার জ্ঞান লাভ করতে পারবে না।

সার্বজনীন স্বীকৃতিঃ

সুফিবাদ স্বতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর সকল মহল এটি গ্রহণ করেনি। আবু নসর সারজি কিতাবুল লুমায় এবং আল কুশাইর তার রিসালায়িত গ্রন্থে সুফিবাদের মূলনীতিসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। তাদের বর্ণনা মতে জানা যায় যে, গোঁড়া মুসলমানগন সুফিদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়েছেন।কিন্তু ইমাম গাজ্জালীর প্রচেষ্টায় সুফিবাদ ও গোঁড়া মতবাদের সমন্বয় ঘটে এবং সুফিবাদ সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃতি লাভ করে। গাযযালির চেষ্টায় সুফিবাদ সুন্নি মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বৈজ্ঞানিক রূপ লাভ করে।

ওয়াহাদুল অজুদ প্রবর্তনঃ

সপ্তম হিজরীতে স্পেনে ইবনুল আরাবী সুফিবাদের ক্রমবিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তিনি সর্বঈশ্বরবাদের প্রচলন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মতবাদের নাম ছিল “ওয়াহাদুল অজুদ” । তার এই মরমী ধারার ক্রমবিকাশে সাহায্য করেছিলেন জালালউদ্দিন রমী (রঃ)। তাঁর মসনবী শরীফ পৃথিবীর ইতিহাসে এক অমূল্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইবনুল আরাবীর এই মতবাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে রুকনুদ্দিন আলাউদ্দৌলা একটি পৃথক মতবাদ গ্রহণ করেন যা শুহুদিয়া নামে পরিচিত। তার এই সম্প্রদায়কে বাহাউদ্দীন বিশেষভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং হিজরী একাদশ শতাব্দীতে এ মতবাদটি ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে রাখে। অতঃপর ১৮৩৭ সালে মোহাম্মদ বিন আলী আলজেরিয়াতে একটি পৃথক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে সুফিবাদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় ক্রমবিকাশ হতে থাকে।

(৪) সূফিবাদের প্রয়োজনীয়তা

সূফিবাদ ইসলামে পবিত্র কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাই সুফিবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।নিম্নে সুফিবাদের কিছু প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো–

আল্লাহর নৈকট্য লাভঃ

নিজের মনকে আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট করার জন্য সুফিবাদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শয়তানের চক্রান্ত ও কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষের মন দুনিয়ার আকর্ষণের দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহর যিকর ও আল্লাহর মুহাব্বত প্রাপ্তির উপযুক্ত ব্যক্তির অন্তর সদা জাগ্রত থাকে।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

কুরআনে বলা হয়েছে,

“জেনে রেখো ,আল্লাহর স্মরণেই আত্মার প্রশান্তি।” (সূরা রা’আদ: ২৮)

আত্মকে পবিত্রকরণের মাধ্যমঃ

আত্মাকে পবিত্র ও কলুষমুক্ত রাখার মাধ্যমে জীবনে সফলতা লাভ করা যায়।

আল্লাহ বলেন, 

“যে ব্যাক্তি আত্মাকে পূত-পবিত্র রাখলো, সে সাফল্য লাভ করল। আর যে ব্যাক্তি আত্মাকে কলুষিত করল সে ধ্বংস হয়ে গেল।” (সূরা আল শামস: ৯-১০)

আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন,

“সেই ব্যক্তিই সফল যে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি অর্জন করে, এবং তার প্রভুর স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।” (সূরা আল আলা: ১৪-১৫)

রাসূল (সাঃ) বলেন,

“নিশ্চয় মানুষের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যে অবস্থিত,তিনি তা যেমন ইচ্ছা পরিবর্তন করেন।” (আল-হাদিস)

লোভ-লালসা ,কামনা-বাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মানুষকে কলুষিত করে। এতে আত্মা অপবিত্র হয়ে পড়ে। সৎকর্ম, সৎ চিন্তা, আল্লাহর যিকর ইত্যাদি মানুষকে আত্মাকে পবিত্র করে তোলে।

তাই আত্মার শুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে রাসুল (সা:) বলেন,

“সাবধান! নিচের মানুষের দেহের মধ্যে একখণ্ড গোশত আছে, যখন তার সুস্থ থাকে, তখন সমস্ত দেহই সুস্থ থাকে। আর যখন তা দূষিত হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত দেহই অসুস্থ হয়ে পড়ে। জেনে রেখো, তা হলো অন্তকরণ।” (আল-হাদিস)

কাজেই সবসময় আত্মাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর সুফিবাদের মাধ্যমে তা অর্জন করা যায়।

কল্যাণ লাভের মাধ্যমঃ

শান্তিময় জীবন যাপনের জন্য সুফিবাদ চর্চা ও বাস্তব জীবনে অনুশীলন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে কল্যাণ লাভের আশা করা যায়।

মহান আল্লাহ বলেন,

“যে ব্যাক্তি আত্মাকে পূত-পবিত্র রাখলো, সে সাফল্য লাভ করল। আর যে ব্যাক্তি আত্মাকে কলুষিত করল সে ধ্বংস হয়ে গেল।” (সূরা আল শামস: ৯-১০)

সকল প্রকার মন্দ এক হয়ে অন্তরে মরিচা ধরে।

অন্তরে যাতে কোনরকম মরিচা না ধরে সেজন্য আল্লাহ বলেন,

“কখনো নয় ,বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের হৃদয়ে জং ধরিয়েছে।” (সূরা মুতাফফিফীন: ১৪ )

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

দেহ ও আত্মার সমন্বয় সাধনঃ

মানুষের দেহ সর্বস্ব নয়। দেহ ব্যতিত তার আরেকটি রূপ আছে আত্মা। দেহ ও আত্মার সংযোগকে বলা হয় মানুষ। দেহ ব্যতীত আত্মা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা। কাজেই দেহহীন আত্মা ও প্রাণহীন দেহ কোনটিই মানুষ পদবাচ্য নয়। এ দুয়ের মিলিত রূপই মানুষ। দেহ ও আত্মার সমন্বয় সাধনই সুফিবাদের অন্যতম কাজ।

হৃদয়ের পবিত্রতা সাধনঃ

সুফিবাদ আত্মিক উন্নতি ও হৃদয়ের পবিত্রতার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। সুফিবাদের মাধ্যমে হৃদয়ে আল্লাহর প্রেম সৃষ্টি হয়।

মানব মনের শূন্যতা দূরীকরণঃ

মানুষ জড়বাদ ও বুদ্ধিবাদের আবর্তে পড়ে জীবনের উচ্চতর মূল্যবোধ সম্পর্কে দিশেহারা। আর মানব মনের এই শূন্যতা দূরীকরণে তাসাউফের গুরুত্ব অপরিহার্য।

স্রষ্টা ও সৃষ্টি পার্থিব ও অপার্থিব জীবনে সমন্বয়ঃ

জীবনের এক চিরন্তন দিক উন্মোচন করে সুফিবাদ মানুষের নিত্য সত্তার অধিকার দিয়েছে।স্রষ্টা ও সৃষ্টি পার্থিব ও অপার্থিব জীবনে সমন্বয় সাধন করে জীবনের মূল্যবোধকে উন্নীত করেছে।

নফসের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তিঃ

তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে মানব মন থেকে কুমন্ত্রণা দূর করে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন করে।

ধর্মের গোঁড়ামি ও যুক্তি প্রবনতার মধ্যে সমন্বয়ঃ

একদিকে গোঁড়া মুসলিম সম্প্রদায় কুরআন ও হাদিসের আক্ষরিক ব্যাখ্যা দিয়েছে অন্যদিকে মুতাজিলা সম্প্রদায় প্রজ্ঞার সাহায্যে ধর্মীয় সমস্যার সমাধান দিয়েছে। এদেরকেও পরম সত্য লাভে সামর্থ্য নয়। সুফিবাদ উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

কলবকে জ্যোতিময় করার জন্যঃ

নফস রুহ জীবাত্মকে প্রেম আস্তনে দগ্ধীভূত করতে না পারলে কলব জ্যোতিময় হবে না। রুহ একপ্রকার নূরানী জ্যোতির্ময় অনুভবকারী চেতনা পদার্থ ও কথা একমাত্র তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে জানা যায়।

ইহজগত ও পরজগতের ব্যবধান ঘুচাতেঃ

যুগে যুগে মানুষ জড়বাদ ও বুদ্ধিবাদের আবর্তে পড়ে জীবনের উচ্চতর মূল্যবোধ সম্পর্কে দিশেহারা হয়েছে। সুফিবাদ দৈহিক ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের মধ্যে সেতু নির্মাণ করে ইহজগত ও পরজগতের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

বস্তুতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার পূর্ণতা সাধনঃ

বিজ্ঞানের গৌরব মানুষকে বস্তুতান্ত্রিক করে তুলেছে। সুফিবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক স্বরূপের নির্দেশ দান করে তার জীবনকে পরিপূর্ণ করে শূন্যতা থেকে রক্ষা করে।সুফিবাদ বস্তুতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার মধ্যে পূর্ণতা আনয়নে আবশ্যক।

চারিত্রিক পরিশুদ্ধি অর্জনঃ

চারিত্রিক পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য সুফিবাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কোরআনে বলা হয়েছে,

“নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধি করেছে। এবং সে ব্যর্থ হয়েছে যে তা (নফস) কলুষিত করেছে।” (৯১:৯-১০)

আখিরাতে সফলতা লাভঃ

আখিরাতে সফলতা লাভের জন্য তাসাউফের গুরুত্ব অনেক।এ সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“যেদিন ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না। তবে যে আল্লাহর কাছে আসবে সুস্থ অন্তরে।” (২৬:৮৮-৮৯)

সঠিক হিদায়াত লাভঃ

এ সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন।” (২৯:৬৯)

ইবাদতে একনিষ্ঠতা অর্জনঃ

বলা হয়েছে,

“আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, আমি তো নিশ্চয়ই নিকটবর্তী।” (২:১৮৬)

সফলতা লাভঃ

এ সম্পর্কে সূরা আল আলাতে বলা হয়েছে,

“অবশ্যই সাফল্য লাভ করবে যে আত্মশুদ্ধি করবে, আর তার রবের নাম স্মরণ করবে, অতঃপর সালাত আদায় করবে।” (সূরা আল আলা: ১৪-১৫)

আত্মিক প্রশান্তি লাভঃ

এ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,

“যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয় জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। ” (সূরা রাদ: ২৮)

মুমিনের অন্তরে নূর বৃদ্ধিঃ

কুরআনে উল্লেখ আছে,

“আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন, ফলে সে তার রবের পক্ষ থেকে নূরের উপর রয়েছে। ” (সূরা আয-যুমার: ২২)

সমাপ্ত।

ডিসক্লেইমার: এই আর্টিকেল/পোস্টটিতে উল্লিখিত তথ্যগুলো একটি নির্দিষ্ট টেক্সটবুক থেকে হুবহু গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে এই তথ্যগুলোর সাথে একমত নই এবং আমি এগুলো সুফিবাদে বিশ্বাস করিনা। ইসলাম ধর্মে সুফিবাদ বলতে কিছু নেই। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের যেই বিশ্বাস পথ ও পদ্ধতি দেখিয়ে গেছেন একমাত্র সেইটা ইসলাম। ইসলামের আলাদা কোর ভার্সন নেই, একটাই ভার্সন যেতে শুধু মুহাম্মদ (সাঃ) শিখিয়েছেন, দেখিয়েছেন বলে গিয়েছেন।। একমাত্র পবিত্র কুরআন ও রাসূলের হাদিসে যা রয়েছে তাই ইসলাম। এখানে এর বাহিরে মানসৃষ্ট সুফিবাদ বা ভিন্ন যেকোন কম, পথ, পদ্ধতি ও বিশ্বাস পরিত্যাজ্য।

See also  সুফিবাদ কি? সুফিবাদ কি ইসলাম সমর্থন করে? সুফিবাদ ও ইসলাম; তাসাউফ কাকে বলে? তাসাউফ এর গুরুত্ব

তাহলে আজ এখানেই শেষ করছি। আশা করি সুফিবাদ সম্পর্কে অল্প কিছুটা হলেও ধারনা দিতে পেরেছি। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

informationbangla.com default featured image compressed

কিছু ইসলাম সম্পর্কিত প্রশ্ন ও তার উত্তর

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার প্রতিটি দিক রয়েছে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল। তবে ধর্মীয় অনেক বিষয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে — যেমন ঈছালে ছওয়াব, ওছীলা, জিন, কারামত কিংবা মেরাজ সম্পর্কে। এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তাই এ পোষ্টে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত কিন্তু নির্ভরযোগ্য উত্তর তুলে ধরেছি, যা পাঠকদের ইসলামের গভীর বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ও সঠিক ধারণা দিতে সহায়তা করবে। ... Read More
ইমানের শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত ১টি বিষয়ভিত্তিক হাদিস

ইমানের শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত ১টি বিষয়ভিত্তিক হাদিস

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: নিম্নে ইমানের শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত ১টি বিষয়ভিত্তিক হাদিসের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা তুলে ধরা হলো- ... Read More
মাজার সম্পর্কে ইসলাম কি বলে, মাজার সম্বন্ধে ভুল ধারণা ও কাজ সমূহ

মাজার সম্পর্কে ইসলাম কি বলে? মাজার সম্বন্ধে ভুল ধারণা ও কাজ সমূহ

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: মাযার সম্বন্ধে ভ্রান্ত/ভুল/মিথ্যা ধারণা সমূহ- প্রশ্নঃ মাজার অর্থ কি? মাজার এর অর্থ? মাজার বাংলা অর্থ? মাজার নামের অর্থ? মাজার শব্দের অর্থ কি? মাজার এর মানে কি? মাজার এর অর্থ কি? প্রশ্নঃ মাজারে মানত করা কি জায়েজ? প্রশ্নঃ মাজারে সেজদা করা যাবে কি? প্রশ্নঃ মাজারের গিলাফ লাগানো কি? মাজার ইসলামের অংশ কি? ইসলামে মাজার এর কোন গুরুত্ব আছে কি? ইসলামিক মাজার বানোর অনুমতি আছে কি? ... Read More
informationbangla.com default featured image compressed

হিজরত শব্দের অর্থ কি? হিজরত কত প্রকার ও কি কি?

○ ইসলাম
আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় হলঃ হিজরত কি? হিজরত শব্দের অর্থ কি? হিজরত কত প্রকার ও কি কি? (১) হিজরত শব্দের অর্থ কি? হিজরত আরবী শব্দ। হিজরুন শব্দ হতে মাসদার এটি। এর মূল বর্ণ হা, জীম, রা। এর অর্থ হচ্ছে ত্যাগ করা, ছেড়ে দেওয়া, ছিন্ন করা, পরিত্যাগ করা, সম্পর্ক শেষ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া, দেশত্যাগ করা ইত্যাদি। (২) হিজরত কি? কামুসুল ফিকহ্ এর গ্রন্থাগারের মতে, “হিজরত বলতে কাফির শাসিত দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে গমন করা।” আলামা খাত্তাবী বলেন, “রাসূল (সাঃ) এর সাথে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের জন্য ধৈর্য্যের সাথে বের হওয়ার নামই হিজরত।” আল্লামা ইবনে হাজার আসকালীন বলেন, “আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করার নামই হিজরত।” এক কথায়, ইসলাম প্রচারের স্বার্থে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে ... Read More
প্রতারণা কাকে বলে প্রতারণা বর্জনের গুরুত্বসমূহ

প্রতারণা কাকে বলে? প্রতারণা বর্জনের গুরুত্ব

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: (১) প্রতারণা কাকে বলে? (২) প্রতারণা বর্জনের গুরুত্ব ... Read More
তাসাউফ এর গুরুত্ব

তাসাউফ এর গুরুত্ব

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: নিম্নে তাসাউফ এর গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- ... Read More
শাফাআত কাকে বলে

শাফাআত কাকে বলে?

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: (১) শাফাআত (২) শাফাআতে কুবরা (৩) শাফাআতে সুগরা ... Read More
ইতিকাফের নিয়ম ও ফজিলতসমূহ

ইতিকাফের নিয়ম ও ফজিলতসমূহ

○ ইসলাম
প্রিয় পাঠক, আমি আজকের এই পোষ্টটিতে ইতিকাফের নিয়ম এবং ইতিকাফের ফজিলতসমূহ সুন্দরভাবে গুছিয়ে ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরার যথা সাধ্য চেষ্টা করেছি। আপনি যদি ইতিকাফের নিয়ম এবং ইতিকাফের ফজিলতসমূহ জানতে সত্যই আগ্রহী হন, আপনি সম্পূর্ণ পোষ্টটি পড়বেন। আশা করি পোষ্টটি পড়ে আপনি অবশ্য উপকৃত হবেন। চলুন শুরু থেকে শুরু করা যাক। আলোচ্য বিষয়: (১) ইতিকাফ কি? ইতিকাফ কী? এতেকাফ কি? (২) ইতিকাফের সময়সীমা (৩) ইতিকাফের ফজিলত, ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত (৪) ইতিকাফের প্রকারভেদ (৫) ইতিকাফের নিয়ম, এতেকাফ করার নিয়ম, ইতিকাফ করার নিয়ম ... Read More
informationbangla.com default featured image compressed

ছাগল কোরবানির নিয়ম

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: নিম্নে ছাগল কোরবানির নিয়মসমূহ তুলে ধরা হলো- (১) যেভাবে ছাগল কুরবানি করতে হবে (২) ছাগলের যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেওয়া যাবে না (৩) ছাগলের যেসব ত্রুটি থাকলেও সেই ছাগলকে কোরবানি দেওয়া যাবে ... Read More
সূরা বাকারার ১১ ও ১২ নং আয়াতের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা

সূরা বাকারার ১১ ও ১২ নং আয়াতের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা

○ ইসলাম
আলোচ্য বিষয়: নিম্নে সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে সূরা বাকারার ১১ ও ১২ নং আয়াতের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা তুলে ধরা হলো- ... Read More