ই-পাসপোর্ট vs এমআরপি পাসপোর্ট

পাসপোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা কেবল পরিচয় প্রমাণ করে না, বরং আন্তর্জাতিক ভ্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে পাসপোর্ট ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটেছে সময়ের সাথে সাথে। পুরনো হাতে লেখা পাসপোর্ট থেকে শুরু করে আধুনিক ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট, প্রযুক্তির অগ্রগতি এই নথিকে আরও নিরাপদ ও ব্যবহারকারী-বান্ধব করে তুলেছে।
এই ব্লগ পোস্টে এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) এবং ই-পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য, এদের বৈশিষ্ট্য, চেহারা, এবং বাংলাদেশে এদের প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই পোস্টটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে পাঠকরা সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারেন ও সঠিক তথ্য সহজে খুঁজে পান।
(১) এমআরপি পাসপোর্ট কী?
এমআরপি পাসপোর্টের পূর্ণরূপ হলো মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টের নামের মধ্যেই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য নিহিত। ‘এম’ মানে মেশিন, ‘আর’ মানে রিডেবল, এবং ‘পি’ মানে পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টে তথ্য এমনভাবে সংরক্ষিত থাকে যাতে এটি মেশিনের মাধ্যমে সহজেই পড়া যায়।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ICAO) এর নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রথম এমআরপি পাসপোর্ট চালু হয়। এর আগে বাংলাদেশে ব্যবহৃত পাসপোর্টগুলো ছিল হাতে লেখা। হাতে লেখা পাসপোর্টে তথ্য যাচাই করতে সময় লাগত এবং নিরাপত্তার দিক থেকেও এটি দুর্বল ছিল। এমআরপি পাসপোর্টের প্রবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো অনেকাংশে সমাধান হয়েছে彼此
(২) ই-পাসপোর্ট কী?
ই-পাসপোর্টের পূর্ণরূপ হলো ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট। এটি এমআরপি পাসপোর্টের তুলনায় আরও উন্নত প্রযুক্তির একটি পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টে একটি ইলেকট্রনিক চিপ সংযুক্ত থাকে, যেখানে পাসপোর্টধারীর বায়োমেট্রিক তথ্য (যেমন আঙুলের ছাপ, মুখের ছবি ইত্যাদি) সংরক্ষিত থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ICAO) এর নির্দেশনা অনুসারে, বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট চালু হয় ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি। এই পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক ভ্রমণে আরও নিরাপদ এবং দ্রুত ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে।
(৩) এমআরপি এবং ই-পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য
এমআরপি এবং ই-পাসপোর্টের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো-
১. ই-পাসপোর্ট সিম্বল
ই-পাসপোর্টের কভার পৃষ্ঠায় একটি নির্দিষ্ট সিম্বল থাকে, যা এটিকে এমআরপি পাসপোর্ট থেকে আলাদা করে। এই সিম্বলটি একটি ছোট চিপের আইকন, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি একটি ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট। এমআরপি পাসপোর্টে এই সিম্বলটি থাকে না। এই সিম্বলের মাধ্যমে আপনি সহজেই ই-পাসপোর্ট শনাক্ত করতে পারবেন।
২. ডিজাইন এবং চেহারা
এমআরপি পাসপোর্ট এবং ই-পাসপোর্টের চেহারায়ও কিছু পার্থক্য রয়েছে। এমআরপি পাসপোর্টের তুলনায় ই-পাসপোর্টের কভারে আরও আধুনিক ডিজাইন ব্যবহৃত হয়। ই-পাসপোর্টে সাধারণত বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক এবং উন্নত নিরাপত্তা ফিচার যুক্ত থাকে।
৩. প্রযুক্তিগত পার্থক্য
এমআরপি এবং ই-পাসপোর্টের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো প্রযুক্তি। এমআরপি পাসপোর্টে তথ্য মেশিনে পড়া যায় এমন ফরম্যাটে থাকে, তবে এটি ম্যানুয়ালি যাচাই করতে হয়। অন্যদিকে, ই-পাসপোর্টে একটি ইলেকট্রনিক চিপ থাকে, যা বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ করে। এই চিপের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া আরও দ্রুত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়।
৪. ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া
এমআরপি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তথ্য যাচাই করে এবং পাসপোর্টে সিল দিয়ে থাকেন। এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং মানুষের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, এটিকে চেক বইয়ের সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তারা স্বাক্ষর যাচাই করে টাকা প্রদান করেন।
অন্যদিকে, ই-পাসপোর্ট এটিএম কার্ডের মতো। এটির মাধ্যমে ব্যবহারকারী নিজেই ইমিগ্রেশন মেশিনে পাসপোর্ট স্ক্যান করে দ্রুত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ই-পাসপোর্টকে আরও সুবিধাজনক এবং দ্রুত করে তুলেছে।
৫. নিরাপত্তা
ই-পাসপোর্টে বায়োমেট্রিক তথ্য এবং ইলেকট্রনিক চিপ থাকায় এটি এমআরপি পাসপোর্টের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ। জালিয়াতি বা তথ্য পরিবর্তনের ঝুঁকি এতে অনেক কম। এমআরপি পাসপোর্টে এই ধরনের উন্নত নিরাপত্তা ফিচার নেই।
(৪) ই-পাসপোর্ট দেখতে কেমন?
ই-পাসপোর্টের বাহ্যিক চেহারা এমআরপি পাসপোর্টের তুলনায় আরও আধুনিক। এর কভারে সাধারণত গাঢ় সবুজ রঙ ব্যবহৃত হয়, এবং কভারে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের পাশাপাশি ই-পাসপোর্ট সিম্বলটি থাকে। এই সিম্বলটি একটি ছোট চিপের আইকন, যা ইঙ্গিত দেয় যে পাসপোর্টটি ইলেকট্রনিক।
ই-পাসপোর্টের অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠাগুলোতেও উন্নত নিরাপত্তা ফিচার যুক্ত থাকে, যেমন হলোগ্রাম, মাইক্রোটেক্সট, এবং ইউভি প্রিন্ট। এই ফিচারগুলো পাসপোর্টকে জালিয়াতি থেকে রক্ষা করে।
(৫) এমআরপি পাসপোর্ট কি বাতিল হয়ে যাবে?
২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট চালু হওয়ার পর থেকে নতুন পাসপোর্ট হিসেবে শুধুমাত্র ই-পাসপোর্টই প্রদান করা হচ্ছে। এমআরপি পাসপোর্ট আর নতুন করে ইস্যু করা হচ্ছে না। তবে, যাদের কাছে আগে থেকে এমআরপি পাসপোর্ট রয়েছে, তারা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এমআরপি পাসপোর্ট পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হবে। যখন কারও এমআরপি পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে, তখন তাকে নতুন করে ই-পাসপোর্ট দেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে সম্পন্ন হবে।
(৬) ই-পাসপোর্টের সুবিধা
ই-পাসপোর্টের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যা এটিকে এমআরপি পাসপোর্টের তুলনায় বেশি জনপ্রিয় করেছে। নিম্নে কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা তুলে ধরা হলো-
১. দ্রুত ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া
ই-পাসপোর্টের ইলেকট্রনিক চিপের কারণে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত হয়। অনেক বিমানবন্দরে স্বয়ংক্রিয় ই-গেট রয়েছে, যেখানে পাসপোর্টধারী নিজেই তথ্য স্ক্যান করে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন।
২. উন্নত নিরাপত্তা
ই-পাসপোর্টে বায়োমেট্রিক তথ্য এবং উন্নত নিরাপত্তা ফিচার থাকায় এটি জালিয়াতির ঝুঁকি কমায়। এটি পাসপোর্টধারীর পরিচয় আরও নিশ্চিতভাবে যাচাই করে।
৩. আন্তর্জাতিক মান
ই-পাসপোর্ট আইসিএওর সর্বশেষ মান অনুযায়ী তৈরি, যা এটিকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। অনেক দেশ এখন ই-পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক করেছে।
৪. ব্যবহারকারী-বান্ধব
ই-পাসপোর্টের মাধ্যমে ভ্রমণকারীরা দ্রুত এবং সহজে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারেন, যা সময় বাঁচায় এবং ভ্রমণকে আরও সুবিধাজনক করে।
(৭) কীভাবে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবেন?
বাংলাদেশে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া এমআরপি পাসপোর্টের মতোই। তবে, এতে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত ধাপ রয়েছে। নিম্নে সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া দেওয়া হলো-
১. অনলাইনে ফর্ম পূরণ: সরকারি ওয়েবসাইটে গিয়ে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে।
২. নথি জমা: জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে।
৩. বায়োমেট্রিক তথ্য: আঙুলের ছাপ এবং ছবি সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট কেন্দ্রে যেতে হবে।
৪. ফি প্রদান: নির্ধারিত ফি জমা দিতে হবে।
৫. পাসপোর্ট সংগ্রহ: আবেদন অনুমোদনের পর পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে।
(৮) ই-পাসপোর্টের ভবিষ্যৎ
ই-পাসপোর্ট বিশ্বব্যাপী একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশও এই প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। ভবিষ্যতে, ই-পাসপোর্ট সম্পূর্ণভাবে এমআরপি পাসপোর্টের স্থান দখল করবে। এটি শুধু নিরাপত্তাই বাড়াবে না, বরং ভ্রমণকারীদের জন্য সুবিধাও বাড়াবে।
ই-পাসপোর্ট এবং এমআরপি পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যারা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে চান। ই-পাসপোর্টের উন্নত প্রযুক্তি, নিরাপত্তা, এবং সুবিধা এটিকে ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশে এমআরপি পাসপোর্ট ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে, এবং ই-পাসপোর্ট এখন নতুন মান।
আশা করা যায়, এই পোস্টটি পাঠকদের জন্য ই-পাসপোর্ট এবং এমআরপি পাসপোর্ট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছে। যদি আপনার এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন থাকে, তবে মন্তব্যে জানান।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।






