বর্গী কারা? বর্গী এলো দেশে কবিতাঃ বর্গী কাকে বলে, বর্গী আক্রমণণের ইতিহাস

বাংলার ইতিহাসে বর্গী শব্দটি একটি ত্রাস ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে চিরকালীন স্থান করে নিয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলায় মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ শুধু অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই ডেকে আনেনি, বরং এটি বাঙালির মানসপটে এমন একটি ভীতিকর ছাপ ফেলেছিল যে, এর প্রভাব আজও আমাদের লোকসংস্কৃতি, ছড়া এবং কবিতায় প্রতিফলিত হয়। “খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে” — এই ছড়াটি আমাদের শৈশবে দাদী-নানীর মুখে শোনা, কিন্তু এর পেছনের ইতিহাস অনেকেই জানেন না।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব বর্গী কারা, বর্গী এলো দেশে কবিতা, বর্গী কাকে বলে এবং বর্গী আক্রমণের ইতিহাস। এই লেখাটি পড়ে আপনি বর্গীদের উৎপত্তি, তাদের আক্রমণের প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাবেন।
(১) বর্গী কারা

বর্গী ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের অশ্বারোহী সৈন্যদল, যারা লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য কুখ্যাত ছিলেন।
মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজী (১৬২৭-১৬৮০) এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। মহারাষ্ট্রের রাইগড়কে রাজধানী করে গড়ে ওঠা এই হিন্দু সাম্রাজ্যটি ১৮১৮ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।
মারাঠারা ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী এবং মুগল আমলে তারা ক্ষত্রিয় যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬১৮-১৭০৭) দক্ষিণ ভারতের সামরিক অভিযানের সময় মারাঠা সাম্রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে মারাঠারা মুগল শাসনের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে অনেকে মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে লুটতরাজ শুরু করে। এই লুটেরাদের মধ্যে বর্গী নামে পরিচিত অশ্বারোহী দলটি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্গী শব্দটি মারাঠি শব্দ বারগির থেকে এসেছে, যার অর্থ বর্শাধারী। মারাঠি ভাষায় বরচি বলতে একটি বিশেষ ধরনের বর্শাকে বোঝানো হতো, যা বর্গীরা তাদের অভিযানে ব্যবহার করত। এই বর্গীরা ছিল মূলত ধনগর জাতীয় লোক, যারা শুধুমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে অভিযানে বের হত। মারাঠা নেতৃত্ব তাদের ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করত, এবং তারা দ্রুতগামী ও আক্রমণাত্মক যুদ্ধকৌশলের জন্য বিখ্যাত ছিল।
বাংলায় এই বর্গীরা ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর নিয়মিতভাবে আক্রমণ চালাত। তারা ফসল লুট করত, গ্রাম জ্বালিয়ে দিত এবং নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাত। এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে বাংলার মানুষ তাদের বর্গী নামে ডাকত, যা পরবর্তীতে ভয় ও ত্রাসের প্রতীক হয়ে ওঠে।
(২) বর্গী এলো দেশে কবিতা

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে বর্গী এলো দেশে ছড়াটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই ছড়াটি শুধু একটি ঘুমপাড়ানি গান নয়, বরং এটি বাংলার মানুষের দুঃখ-বেদনা ও অসহায়ত্বের একটি কাব্যিক প্রকাশ। নিচে ছড়াটির পূর্ণাঙ্গ রূপটি দেওয়া হলো-
খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
ধান ফুরল, পান ফুরল
খাজনার উপায় কি?
আর ক’টা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিয়াজ গেছে পচে
সর্ষে ক্ষেতে জল
খরা-বন্যায় শেষ করিল
বর্ষ এর ফসল।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি
সব শুধু খালি
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে
শত শত তালি।
ধানের গাছ, বিলের মাছ
যাই কিছু ছিল
নদীর টানে বাঁধটি ভেঙে
সবই ভেসে গেল।
এ বারেতে পাঁচ গাঁয়েতে
দিয়েছি আলুর সার
আর কটা দিন সবুর করো
মশাই জমিদার।।
এই ছড়াটি বর্গী আক্রমণের সময়কার বাংলার কৃষকদের দুর্দশার একটি হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা। ছড়ার প্রতিটি লাইন বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের সংগ্রাম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্গীদের লুটতরাজের প্রভাবকে তুলে ধরে। “বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে” — এই লাইনটি কৃষকদের অসহায়ত্ব ও জমিদারের কাছে খাজনা দেওয়ার অক্ষমতার প্রতীক। ছড়াটি শুধু একটি গান নয়, এটি বাংলার ইতিহাসের একটি মর্মস্পর্শী দলিল।
এই ছড়াটি বাংলার গ্রামে গ্রামে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হত। এর মাধ্যমে বাঙালি মায়েরা তাদের সন্তানদের কাছে ইতিহাসের একটি অংশ অজান্তেই তুলে ধরতেন। আজও এই ছড়াটি বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
(৩) বর্গী কাকে বলে?

বর্গী শব্দটি মারাঠি বারগির থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ বর্শাধারী অশ্বারোহী যোদ্ধা। বর্গীরা ছিল মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের একটি বিশেষ সৈন্যদল, যারা দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে আক্রমণ চালাত। তারা মূলত ধনগর জাতীয় মানুষ ছিল, যারা মহারাষ্ট্র, গুজরাট, গোয়া, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশে বাস করত। মারাঠা নেতা ছত্রপতি শিবাজীর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যে বর্গীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
বর্গীদের যুদ্ধকৌশল ছিল অত্যন্ত কার্যকর। তারা দ্রুত আক্রমণ করত, লুটপাট করত এবং দ্রুত পিছু হটত। এই কৌশলের কারণে তাদের ধরা প্রায় অসম্ভব ছিল। বাংলায় বর্গীদের আক্রমণ মূলত মুগল শাসনের প্রতি তাদের ক্ষোভের ফল ছিল। মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব মারাঠাদের মনসব পদ দিয়ে মুগল সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এতে তাদের রোষ কমেনি। ফলে বর্গীরা মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে, বিশেষ করে সুবা বাংলায়, লুটতরাজ শুরু করে।
বাংলার মানুষের কাছে বর্গী শব্দটি শুধু মারাঠা সৈন্যদলের নাম নয়, এটি ত্রাস ও ধ্বংসের প্রতীক। বর্গীদের আক্রমণের সময় গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে যেত, ফসল লুট হতো, এবং মানুষ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াত। এই কারণে বর্গী শব্দটি বাংলার জনমানসে একটি ভয়ঙ্কর স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে।
(৪) বর্গী আক্রমণের ইতিহাস

বর্গীদের আক্রমণ বাংলার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে বর্গীরা বাংলায় বারবার আক্রমণ চালায়। এই সময় বাংলা ছিল মুগল শাসনাধীন একটি প্রদেশ, এবং নবাব আলীবর্দী খান (১৭৪০-১৭৫৬) এই প্রদেশের শাসক ছিলেন। বর্গীদের আক্রমণের প্রধান কারণ ছিল মুগল শাসনের প্রতি তাদের ক্ষোভ এবং অর্থনৈতিক লাভের আকাঙ্ক্ষা।
ক) বর্গী আক্রমণের শুরু (১৭৪১-১৭৪২)
১৭৪১ সালে বর্গীরা প্রথমবারের মতো বাংলায় আক্রমণ চালায়। তাদের নেতা ছিলেন ভাস্কর পন্ডিত। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল বর্গীরা বর্ধমান (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) আক্রমণ করে। নবাব আলীবর্দী খান সংবাদ পেয়ে সৈন্য নিয়ে বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু বর্গীরা নবাবের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ২৬ এপ্রিল বর্গীদের ঘেরাও থেকে নবাব কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন।
৬ মে, ১৭৪২ সালে বর্গীরা মুর্শিদাবাদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তখন নবাব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদে ছিলেন না। বর্গীরা মুর্শিদাবাদের একটি বড় বাজার পুড়িয়ে দেয় এবং ধনী ব্যবসায়ী জগৎ শেঠের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে। পরের দিন নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরলেও বর্গীরা ততক্ষণে দক্ষিণে পালিয়ে যায়।
খ) বর্গীদের ধারাবাহিক আক্রমণ (১৭৪৩-১৭৫১)
১৭৪৩ সালে বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমণ করে। নবাব আলীবর্দী খান মুগল সৈন্যদের নিয়ে মেদিনীপুরে অগ্রসর হন এবং ৯ ফেব্রুয়ারি তুমুল যুদ্ধে বর্গীদের পরাজিত করেন। কিন্তু বর্গীরা হাল ছাড়েনি। ১৭৪৪ সালে ভাস্কর পন্ডিত আবার বাংলায় আক্রমণ চালান। এবার নবাব ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেন। তিনি ভাস্কর পন্ডিতকে বৈঠকের নামে আমন্ত্রণ জানান এবং লুকানো মুগল সৈন্যদের দিয়ে তাকে ও তার ২১ জন সঙ্গীকে হত্যা করেন।
১৭৫০ সালে বর্গীরা আবার বাংলায় হানা দেয়। ১৭৫১ সালে তাদের আক্রমণের তীব্রতা এতটাই বেড়ে যায় যে, নবাব আলীবর্দী খান বাধ্য হয়ে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন এবং মারাঠাদের বার্ষিক চৌথ (রাজস্বের একটি অংশ) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এই চুক্তির মাধ্যমে বর্গী আক্রমণ কিছুটা হ্রাস পায়, কিন্তু মারাঠারা পরবর্তীতে চুক্তি ভঙ্গ করে। ১৭৫২ সালে মারাঠা সৈন্যরা মীর হাবিবকে হত্যা করে এবং উড়িষ্যায় তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
গ) বর্গী আক্রমণের প্রভাব
বর্গী আক্রমণ বাংলার অর্থনীতি ও সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বাংলার বিখ্যাত রেশমি কাপড়ের বাজার (আড়ং) লোকশূন্য হয়ে পড়ে। খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। বর্গীরা গ্রামের পর গ্রাম লুট করে, ফসল ধ্বংস করে এবং মানুষকে হত্যা করে। এর ফলে বহু মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশ) পালিয়ে যায়। এই অভিবাসনের ফলে পূর্বাঞ্চলে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হয়।
বাংলাপিডিয়ায় মোহাম্মদ শাহ লিখেছেন, বর্গীদের ঘন ঘন আক্রমণ বাংলাকে মহাবিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। এই সময় খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাংলার দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বর্গীদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যাযজ্ঞ বাংলার মানুষের মনে এমন ত্রাস সৃষ্টি করেছিল যে, এই ভীতি বাংলার শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে স্থান পেয়েছে।
ঘ) বর্গীদের সহায়ক: মীর হাবিব
বর্গী আক্রমণের পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল মীর হাবিব নামে একজন বিশ্বাসঘাতকের। মীর হাবিব ছিলেন নবাব আলীবর্দী খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, কিন্তু তিনি বর্গীদের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। বাংলার ভূখণ্ড সম্পর্কে তার বিস্তারিত জ্ঞান বর্গীদের আক্রমণকে আরও সহজ করে তুলেছিল। ১৭৫১ সালের সন্ধিচুক্তির পর মীর হাবিবকে উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু ১৭৫২ সালে মারাঠারা তাকে হত্যা করে।
(৫) শেষকথা
বর্গী আক্রমণ বাংলার ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়। এই আক্রমণ শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতিই করেনি, বরং বাংলার মানুষের মনে গভীর ভয়ের ছাপ রেখে গেছে।
বর্গী এলো দেশে ছড়াটি এই ভয় ও দুর্দশার একটি কাব্যিক প্রকাশ। বর্গীদের আক্রমণের ইতিহাস আমাদের বোঝায় যে, যুদ্ধ ও লুটতরাজ কীভাবে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে। আজও বাংলার লোকসংস্কৃতিতে বর্গীদের স্মৃতি জীবন্ত, এবং এই ইতিহাস আমাদের অতীতের শিক্ষা থেকে ভবিষ্যৎ গড়ার প্রেরণা দেয়।
প্রিয় বন্ধু, আশা উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনি বর্গী কারা? বর্গী এলো দেশে কবিতাঃ বর্গী কাকে বলে, বর্গী আক্রমণণের ইতিহাস সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পেরেছেন। তো আজকে এখানেই থাকলো।
[তথ্যসূত্র: সিয়ার উল মুখতারিন ও বাংলাপিডিয়া]
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।