শলুক মসলা চাষের পদ্ধতি

শলুক মসলা চাষের পদ্ধতি

শলুক আম্বেলিফেরি (Anethum graveolens L.) Umbelliferae পরিবার ভূক্ত অপ্রধান বীজ জাতীয় সুগন্ধি মসলা ফসল। ভারতে এটি দিল (উরষষ) নামে পরিচত।

এই মসলাটির পাতা বিভিন্ন খাবারের গন্ধ এবং স্বাদ বৃদ্ধির জন্য কনফেকশনারী ও রন্ধনশালার দৈনন্দিন খাবার তৈরীতে ব্যবহার হয়ে থাকে।

শলুক ফসলটি ওষধি গুনসম্পন্ন এবং এতে বিভিন্ন উদ্বায়ী তেল যেমন অ্যনিথোল, লোনন, আম্বেলিফেরন, কারভোন আছে যা বিভিন্ন ঔষধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে এই ফসলটি এখনো বানিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হয় না। তবে অল্প পরিসরে দেশের অভ্যন্তরীন চাহিদা মেটানোর জন্যে শলুক চাষ করা হয়ে থাকে।

(১) শলুকের মসলার জাত ও গাছের বৈশিষ্ট্য

বারি শলুক-১:

বারি শলুক-১
বারি শলুক-১
  • চর ও বরেন্দ্র অঞ্চলসহ জাতটি সারা দেশে চাষ করা যায়।
  • শলুক গাছ উচ্চতায় ১২০-১৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
  • প্রতি গাছে গড়ে ৭-৮ টি প্রাথমিক শাখাথাকে।
  • আম্বেল সংখ্যা ৮০-৯০ টি।
  • প্রতি আম্বেলে আম্বেললেটের সংখ্যা প্রায় ১৫-১৬ টি এবং প্রতি আম্বেললেটে বীজের সংখ্যা প্রায় ১৪-১৬ টি।
  • প্রতি ১০০০ বীজের গড় ওজন ৪.০-৪.২ গ্রাম।
  • বীজ এর ফলন প্রতি হেক্টরে ২.০০-২.৪০ টন।
  • এই জাতের জীবনকাল ১২০-১২৫ দিন।

(২) শলুক মসলা চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম

ক) মাটি ও আবহাওয়া

  • প্রায় সব রকমের মাটিতেই করা চাষ করা যায়। তবে বেলে দো-আঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ মাটি শলুক চাষের জন্য উপযোগী।
  • শলুক অধিক জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় জমির পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • ঠান্ডা আবহাওয়া শলুকের বীজ উৎপাদনের জন্য অনুকুল বলে রবি মৌসুমে এর চাষ করা হয়ে থাকে। উচ্চ তাপমাত্রায় ও খরায় শলুক বীজের ফলন ভাল হয় না।
  • ফুল ফোটার সময় বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত কুয়াশা হলে শলুকের ফলন কমে যায় এবং বীজের মান খারাপ হয়ে যায়।

খ) বপন সময়

  • আশ্বিন থেকে কার্ত্তিক (অক্টবর-নভেম্বর) মাস বীজ ফসলের জন্য উত্তম।
  • সাথী ফসল হিসাবে মরিচ, শাক-সব্জি, আখ, আলু, ডাল, মসলা জাতীয় অন্য ফসলের জমিতে শলুকের চাষ করা যায়।
  • অতিরিক্ত সূর্যালোকে বীজ বপন করলে অঙ্কুরোদগমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শলুক বীজের জন্য বিলম্বে বীজ বপনে এর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয় এবং বিভিন্ন রোগবালাই এর আক্রমন বেড়ে যায় ও বীজের মান খারাপ হয়ে ফলন কমে যায়।

গ) জমি তৈরি

মাটির প্রকারভেদে ৪-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরী করতে হবে। পরে জমির দুই ব্লকের মাঝে পানি নিস্কাশনের জন্য নালা রেখে জমি তৈরী করা হয়।

ঘ) বীজের হার

সারিতে হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি এবং ছিটিয়ে বোনার ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।

ঙ) বীজ বপন

  • শলুকের বীজ বোনার আগে পানিতে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে বুনলে তাড়াতাড়ি অঙ্কুরোদগম হয়।
  • সারিতে বোনার ক্ষেত্রে মাটির ২-৩ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করে, সারি থেকে সারির দুরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার, গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৮-১০ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হবে।
  • বপনকৃত বীজ অঙ্কুরোদগম হতে সাধারণত ৮-১০ দিন সময় লাগে।
  • জমির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে বীজ বপনের পর পরই হালকা সেচ দিতে হবে। তাতে অঙ্কুরোদগম বৃদ্ধি পাবে।

চ) সারের পরিমান ও প্রয়োগ পদ্ধতি

শলুক চাষের জন্য হেক্টর প্রতি নীচের হারে সার প্রয়োগ করতে হয়।

সার মোট পরিমানশেষ চাষের সময়পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে: ১ম কিস্তিপরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে: ২য় কিস্তি
গোবর/ভার্কিম্পোস্ট৫ টন/৩ টনসব
ইউরিয়া১৭০ কেজি৮৫ কেজি৮৫ কেজি
টিএসপি১৭০ কেজিসব
এমওপি১২০ কেজি৬০ কেজি৬০ কেজি
জিপসাম৮৫ কেজিসব

জমি তৈরীর সময় গোবর, ১/২ এমওপি, টিএসপি ও জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

চারা গজানোর ২৫ দিন পর ১ম কিস্তিতে ১/২ ইউরিয়া এর সাথে ১/২ এমওপি এবং ফুল ফোটার পর পর বাকি ইউরিয়া সার হালকা সেচের সাথে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

ছ) আন্তঃপরিচর্যা

  • বীজ বপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে প্রথম নিড়ানী দিতে হবে। একই ভাবে একই সময়ের ব্যবধানে পরবর্তী নিড়ানী সমূহ দিতে হবে।
  • প্রতিবার সেচের পর জমির ’জো’ আসা মাত্র মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
  • চারা গজানোর পর থেকে ২/৩ ধাপে ৪-৫ দিন পরপর নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে চারা পাতলা করে দিতে হবে।

জ) সেচ

শলুক ফসলে ৩-৪ টি সেচ প্রয়োগ করতে হবে। গজানোর সময় হালকা সেচ, ফুল আসার আগে ও দানা গঠনের সময় সেচ দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এতে বীজ পুষ্ট ও ফলন বেশী হয়।

ঝ) ফসল সংগ্রহ

  • বপনের ১২০-১২৫ দিন পর শলুক পাকে। পাকলে বীজগুলো হালকা তামাটে হয়ে যায়।
  • সাধারনত খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্যের আলোর প্রখরতা বৃদ্ধির পূর্বে গাছ উঠাতে হবে। শলুকের বীজ হালকা তামাটে অবস্থায় থাকতেই গাছ সহ বীজ তুলতে হবে। শলুকের বীজ সাধারনত রৌদ্রাজ্জল দিনে সংগ্রহ করতে হবে।
  • বীজ সংগ্রহের পর এক জায়গায় গাদা করে রাখা যাবে না কারন গাদা করে রাখলে বীজ কালচে হয়ে যায়।
  • বীজ রোদে শুকিয়ে ঝাড়াই-মাড়াই করে পৃথক করা হয়। বীজে আর্দ্রতার পরিমান ৮-১০% রেখে শুকিয়ে ভালোভাবে সংরক্ষন করতে হবে।

ঞ) ফলন

পর্যাপ্ত পরিচর্যা ও সেচ প্রয়োগে শুকনা বীজের ফলন কমবেশী হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত পরিচর্যা করলে প্রায় ২.০০-২.৪০ টন/ হেক্টর ফলন পাওয়া যায়।

(৩) শলুক চাষে পোকা ও রোগ দমন ব্যবস্থাপনা

ক) জাব পোকা

কীটপতঙ্গের মধ্যে শলুকে জাব পোকার আক্রমন লক্ষ্য করা যায়। কালচে রঙের ছোট পোকা গাছের কান্ডসহ বীজের উপর বসে রস চুষে খায়।

আক্রমণ বেশী হলে বীজ কালো হয়ে গাছ শুকিয়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। গাছে ফুল ও ফল ধরার সময় জাব পোকার আক্রমণ বেশী হয়।

দমন: প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন-১০০ ইসি বা ১ মিলিলিটার কনফিডর-২৫ ইসি ভালোভাবে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।

খ) আম্বেল ব্লাইট

জাতটিতে রোগের আক্রমণ অন্যান্য জার্মপ্লাজম এর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম হয়। তবে আবহাওয়া কুয়াশাচ্ছন্ন এবং হঠাৎ রাত্রির তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়, তবে মাঝে মাঝে আম্বেল ব্লাইট রোগের আক্রমণ হতে পারে।

এ রোগের আক্রমণে এই রোগের আক্রমনে গাছের আম্বেলগুলো কালচে হয়ে সমস্ত গাছ শুকিয়ে যায়।

দমন: রোগের লক্ষণ দেখা মাত্র প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মি.লি. এমিস্টারটপ বা ৩ গ্রাম ক্যাবরিওটপ মিশিয়ে সমস্ত গাছে ৭-১০ দিন পর পর বিকালে স্প্রে করতে হবে।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বীজ ও বীজতলা তৈরি

বীজ ও বীজতলা তৈরি

আলোচ্য বিষয়: (১) বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি (২) মানসম্মত বীজের উৎপাদন (৩) বীজ হতে চারা উৎপাদন
কচু চাষ পদ্ধতি পানি কচু চাষ কীভাবে করতে হয় (রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনাসহ)

কচু চাষ পদ্ধতি: পানি কচু চাষ কীভাবে করতে হয়? পানি কচুর ফলন

আলোচ্য বিষয়: (১) পানি কচু কী? (২) পানি কচুর জাতসমূহ (৩) পানি কচু চাষ কীভাবে করতে হয়? কচু চাষ পদ্ধতি (৪) পানি কচুর পোকামাকড় দমন ও এর প্রতিকার (৫) কচুর বিভিন্ন রোগ ও তার দমন ব্যবস্থাপনা
সহজে লাল শাক চাষের পদ্ধতি

সহজে লাল শাক চাষের পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: নিম্নে সহজভাবে লাল শাক চাষের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
বারি চীনাশাক ও বাটিশাক চাষ পদ্ধতি

বারি চীনাশাক ও বাটিশাক চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) বারি চীনাশাক পরিচিত (২) বারি বাটিশাক পরিচিত (৩) বারি চীনাশাক ও বাটিশাক চাষ পদ্ধতি
ফটোপিরিয়ডিজম কি, কাকে বলে, দিবা দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ

ফটোপিরিয়ডিজম কি/কাকে বলে? দিবা দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ

আলোচ্য বিষয়: (১) ফটোপিরিয়ডিজম কি/কাকে বলে? (২) দিবা দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ (৩) ফটোপিরিয়ডিজমের তাৎপর্য (৪) বিভিন্ন ধরনের দিবা দৈর্ঘ্য নিরপেক্ষ ফসল ও ফসলের জাত চিহ্নতকরণ
বাড়িতে সহজে জৈব সার তৈরির উপায়

বাড়িতে সহজে জৈব সার তৈরির উপায়

আলোচ্য বিষয়: নিম্নে বাড়িতে সহজে জৈব সার তৈরির উপায় বর্ণানা করা হলো- (১) জৈব সার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ? (২) বাড়িতে জৈব সার তৈরির উপকারিতা (৩) জৈব সার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ (৪) জৈব সার তৈরির বিভিন্ন উপায় ক) কম্পোস্টিং (কম্পোস্ট তৈরি) খ) ভার্মিকম্পোস্টিং (কেঁচো দিয়ে সার তৈরি) গ) তরল জৈব সার তৈরি ঘ) গোবর দিয়ে জৈব সার (৫) জৈব সার ব্যবহারের নিয়ম (৬) জৈব সার তৈরির সময় সতর্কতা (৭) জৈব সারের পরিবেশগত প্রভাব
ধুন্দুলের জাতের নাম ও চাষের পদ্ধতি

ধুন্দুলের জাতের নাম ও চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়: (১) ধুন্দুলের জাতের নাম ও পরিচিতি (২) ধুন্দুলের চাষ পদ্ধতি ও নিয়ম
উদ্যান ফসল কি/কাকে বলে? মাঠ ফসল ও উদ্যান ফসলের মাঝে পার্থক্য কী? উদ্যান ফসলের বৈশিষ্ট্য, উদ্যান ফসল কোনটি? উদ্যান ফসল কত প্রকার? উদ্যান ফসল লাভজনক কেন?

উদ্যান ফসল কি/কাকে বলে? মাঠ ফসল ও উদ্যান ফসলের মাঝে পার্থক্য কী? উদ্যান ফসলের বৈশিষ্ট্য, উদ্যান ফসল কোনটি? উদ্যান ফসল কত প্রকার? উদ্যান ফসল লাভজনক কেন?

আলোচ্য বিষয়: (১) উদ্যান ফসল কি/কাকে বলে? (২) উদ্যান ফসলের বৈশিষ্ট্য (৩) উদ্যান ফসল কোনটি? (৪) উদ্যান ফসল কত প্রকার? (৫) উদ্যান ফসল লাভজনক কেন? (৬) মাঠ ফসল ও উদ্যান ফসলের মাঝে পার্থক্য কী
সেচ কি, সেচ কাকে বলে, সেচ পদ্ধতি কয়টি, কলস সেচ পদ্ধতি, প্রযুক্তির বর্ণনা

সেচ কি? সেচ কাকে বলে? সেচ পদ্ধতি কয়টি? কলস সেচ পদ্ধতি/প্রযুক্তির বর্ণনা

আলোচ্য বিষয়: (১) সেচ কি? সেচ কাকে বলে? (২) কখন, কী পরিমাণ সেচ দিতে হয়? (৩) সেচের পানির উৎস (৪) সেচ পদ্ধতি কয়টি? (৫) কলস সেচ পদ্ধতি/প্রযুক্তির বর্ণনা
উচ্চ ফলনশীল গম বীজের নাম ও আধুনিক গম চাষ পদ্ধতি কৌশল

উচ্চ ফলনশীল গম বীজের নাম ও আধুনিক গম চাষ পদ্ধতি/কৌশল

আলোচ্য বিষয়: (১) উচ্চ ফলনশীল গম বীজের নাম (২) আধুনিক গম চাষ পদ্ধতি/কৌশল (৩) বীজ গম  সঠিকভাবে সংগ্রহ এবং  সংরক্ষণের নিয়ম