১৫টি উন্নত জাতের গাভী চেনার উপায় ও লক্ষণসমূহ

আমাদের দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধিতে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও দারিদ্র দূরীকরণে দুগ্ধ খামারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুগ্ধ খামার স্থাপনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই একই সুতোয় গাঁথা। খামার স্থাপনের পূর্বে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করে কাজ করতে হয় ঠিক তেমনি খামার স্থাপনের পর খামারের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি দিতে হয়। দুগ্ধ খামারের মূল উৎপাদিত দ্রব্য হচ্ছে দুধ। তাই দুগ্ধবতী গাভী চেনার উপায় বা উন্নত জাতের গাভী চেনার উপায় সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
(১) উন্নত জাতের গাভী চেনার লক্ষণসমূহ

একটি দুগ্ধবতী গাভী চেনার উপায় বা উন্নত জাতের গাভী চেনার লক্ষণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১। উন্নত জাতের গাভী সামঞ্জস্যপূর্ণ নিখঁত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হবে।
২। পিছনের অংশ বেশি চওড়া এবং দাঁড়ানো অবস্থায় পিছনের পা দুটি বেশি ফাঁক থাকে।
৩। দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।
৪। ভালজাতের গাভীর পাঁজরগুলো আলাদা এবং স্ফীত দেখায়।
৫। দেহ বেশ বড় এবং দেহের আকার সামনের দিকে সরু এবং পিছনের দিকে ভারী হয়।
৬। চামড়া পাতলা ও মসৃণ প্রকৃতির হয়।
৭। ভালজাতের গাভীর শরীর ঢিলেঢালা ও নাদুশ-নুদুশ হয়।
৮। ওলান সুগঠিত নরম, আকারে বড়, চওড়া এবং ওলান শক্তভাবে শরীরের সাথে আটকানো থাকে।
৯। ওলানের বাঁট চারটি সমান আকৃতির ও সমান দূরত্বে অবস্থিত হবে।
১০। দুধ দোহনের আগে ওলান শক্ত থাকে এবং দোহনের পর চুপসে যায়।
১১। ওলানের সামনে নাভীর দিকে সুস্পষ্ট ও উন্নত দুগ্ধশিরা স্পষ্ট দেখা যায়।
১২। উন্নত জাতের গাভীর নাকের ছিদ্র বড় ও খোলা হয়।
১৩। একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যবান গাভীর স্বভাব অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির হয়।
অর্থ্যাৎ, দেশী গাভী সংকরায়নের মাধ্যমে উন্নত জাতের গাভীর উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুষম খাদ্য প্রদান ও স্বাস্থ্যসম্মত পালন ব্যাবস্থার মাধ্যমে একটি সংকর বা উন্নত জাতের গাভী হতে দৈনিক ২৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। উন্নত জাতের গাভী সাধারনত ত্রিকোনাকৃতির হয়। এদের দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।
(২) উন্নত জাতের গাভী চেনার উপায়

এছাড়াও উন্নত জাতের গাভীর চেনা ও দুগ্ধবতী গাভী চেনার উপায় বা ক্রয় করারর সময় যেসল বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো-
ডেইরি খামার লাভজনক করতে চাইলে উন্নত জাতের গাভী নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টি ঠিকমত পালন করতে না পারলে ডেইরি খামার লাভজনক তো হবেই না উপরন্তু পুঁজিও হারাবেন। তাই গাভী কেনার আগে অবশ্যই ভালো দুধ দেওয়ার লক্ষণবিশিষ্ট গাভীটিই নির্বাচন করতে হবে।
কারণ দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা সব গাভীর এক রকম নয়। সুষম খাবার, উন্নত বাসস্থান, সঠিক পরিচর্যাসহ আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লালন-পালন করার পরও শুধু গাভী নির্বাচনে ভুল করলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দুধ উৎপাদন সম্ভব হবে না। আজ ভালো জাতের দুগ্ধবতী গাভী নির্বাচনের কিছু লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খামারিদের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
ক) উন্নত জাতের গাভীর দৈহিক গঠন
- দেহের আকার বড় হবে, পেট থাকবে ঢিলাঢালা, পা শিথিল, চওড়া কপাল ও মাথা ছোট একটি উৎকৃষ্ট দুগ্ধবতী গাভীর বৈশিষ্ট্য।
- ভালো জাতের গাভীর শরীরের চামড়া থাকবে পাতলা, নরম ও আলগা থাকে।
- দুধেল গাভীর ত্বকে থাকে চাকচিক্য। বুক বেশ গভীর ও প্রশস্ত।
- সামনের ও পেছনের পা দুটির মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক থাকবে।
- পেছনের পা সামনের পায়ের চেয়ে বড় হয়।
- গাভীর মুখগহ্বর ও নাসিকা প্রশস্ত হবে।
- উৎকৃষ্ট গাভীর চোখ সবসময় উজ্জ্বল হবে।
- দেহ তেমন চর্বিবহুল হবে না।
- দুগ্ধবতী গাভীর শরীর সাধারণত অপ্রয়োজনীয় পেশিমুক্ত থাকে।
- উন্নত জাতের গাভীর দেহ গোঁজ আকৃতির।
- ভালো জাতের গাভীর পেছনের দিক সামনের দিক অপেক্ষা প্রশস্ত হবে।
- তাই উন্নত দুগ্ধবতী গাভীকে পেছনের দিক থেকে গোঁজকৃতি দেখায়।
- প্রশস্ত চওড়া পাছা ও পেছনের পা দুটির মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক উন্নত গাভীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- পেছনের পা দুটির মধ্যে পর্যাপ্ত ফাঁক থাকলে ওলান বড় হওয়ার সুযোগ থাকে।
খ) উন্নত জাতের গাভীর ওলান

উন্নত জাতের গাভীর ওলানের বৈশিষ্ট্য হলো-
- ভালো গাভীর ওলান বেশ বড়, চওড়া, মেদহীন এবং কক্ষগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
- ওলান সামনে ও পেছনে সমভাবে প্রসারিত থাকে।
- ওলানের পেছন দিক সুডৌল ও প্রশস্ত হয়। পাশ থেকে ওলানের তলদেশ সমতল দেখায়।
- দুগ্ধবতী গাভীর ওলান স্পঞ্জের ন্যায় নরম থাকে যা দুধ দোহনের পূর্বে বড় দেখায় এবং পরে সংকুচিত হয়ে ঝুলে থাকে।
- অধিক মাংসল ও চর্বিযুক্ত ওলান ভালো নয়। এ ধরনের ওলানে দুধ ধারনের জায়গা কম থাকে।
গ) উন্নত জাতের গাভীর বাঁট
- তাছাড়া উৎকৃষ্ট গাভীর বাঁটগুলো প্রায় একই মাপের এবং সমান দূরত্বে থাকবে।
- বাঁটের আকার দোহন উপযোগী হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
ঘ) উন্নত জাতের গাভীর দুধের শিরা
উত্তম দুগ্ধবতী গাভীর পেটের নিচে ওলানের সঙ্গে সংযুক্ত সুস্পষ্ট শাখা-প্রশাখাযুক্ত দুধের শিরা থাকে।
ঙ) উন্নত জাতের গাভীর প্রকৃতি
- দুগ্ধবতী গাভী শান্ত, ধীরস্থির ও মাতৃভাবাপন্ন হয়।
- উন্নত দুগ্ধবতী গাভী সাধারণ ভীত প্রকৃতির হয়, দুধ দোহনকালে অস্থিরতা প্রকাশ করে না।
- এদের হাঁটাচলাও ধীর ও মন্থর প্রকৃতির হয়।
চ) উন্নত জাতের গাভীর বয়স
- সাধারণত একটি গাভী প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত বাচ্চা ও দুধ উৎপাদন করে। সুতরাং গাভীর বয়স জানা আবশ্যক।
- তাছাড়া গাভীর প্রথম প্রসবে যেসব বিপদের সম্ভাবনা থাকে সেগুলো একবার প্রসবের পর দূর হয়ে যায়।
ছ) উন্নত জাতের গাভীর দুধ উৎপাদন
- সাধারণত পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদনকারী গাভী উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে অনেক গাভী দুধ বেশি দিলেও দুধ পাতলা হয় এবং ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ কম থাকে।
- সুতরাং দুধে ফ্যাটের পরিমাণ যাচাই করে গাভীর উৎকৃষ্টতা বিচার করা প্রয়োজন। স্বাভাবিক ফ্যাটযুক্ত দুধ ঘন ও ঈষৎ হলদে বর্ণের হয়।

জ) উন্নত জাতের গাভীর লেজ
লেজ দেখেও ভাল জাতের গাভীর বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায়। ভালো জাতের গাভীর লেজ সবসময় লম্বা হয়। লেজের অগ্রভাগের চুলের গুচ্ছও বড় হয়।
ঝ) উন্নত জাতের গাভীর বংশ
বংশ ইতিহাস জেনেও দুধেল গাভীর বৈশিষ্ট্য যাচাই করা যায়। খনার বচনে আছে, ‘যেমন মা তেমন ছা’।
তাই গাভীর মা-নানীর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা যাচাই করে নিতে পারলে উৎকৃষ্ট দুগ্ধবতী গাভী নির্বাচন ও মূল্যায়ন সহজ হয়।
প্রথমে আপনাকে দেখতে হবে মা আসলে কেমন?
কারণ মায়ের ওপর নির্ভর করে গরুর জাত আসলে কেমন হবে।
একটি গাভীর যদি ১০ লিটার দুধ হয় এবং তার থেকে যে বকনা গরু আসবে,
সেটির মায়ের থেকে অবশ্যই একটু বেশি দুধ হবে।
তারপর দেখতে হবে দেহ, দেহটা বেশ বড় এবং মোটা সোটা হওয়া বাঞ্চনীয় কারণ জমি যত বড় হবে ফসল তত বেশি হবে।
একটি ভাল জাতের ফ্রিজিয়ান গরুর মাথাটা খাটো এবং মোটা হয়ে থাকে, কোন ধরনের গলকম্বল থাকেনা এবং খুব সামান্য পরিমাণ গলকম্বল থাকে।
গলোকম্বল বলতে গলার ঝুল কে বোঝানো হয়েছে, কান দুটো অবশ্যই ছোট ছোট হবে অনেকটা কাঁঠাল পাতার মতো।
গলাটা খাটো হবে। পা গুলো লম্বা লম্বা এবং মোটা হবে।
লেজটা খাটো হবে। পিছনের রানের মাংস কম হবে এবং সামান থাকবে।
আমরা অনেকে মনে করি, ভাল জাতের গাভীর হয়তো সাদাকালো প্রিন্ট অথবা সাদা হয় কিন্তু সাদাকালো হলেই যে, বেশি পরিমাণ দুধ দিবে অথবা মান ভাল হবে তা কিন্তু নয়।
একটি ভাল জাতের গাভীর মূল বৈশিষ্ট্য থাকে শারীরিক গঠন এবং বংশগত ঐতিহ্য। সাদাকালো হলেই যে বেশি পরিমাণ দুধ দেয় এটা কিন্তু আমাদের ভুল ধারণা।
অনেক কাল গাভী আছে যেগুলোর থেকে আমরা ২০ থেকে ২৫ লিটার অথবা ৩০ লিটার দুধ পেয়ে থাকি।
তাই আমার প্রিয় খামারি বন্ধুরা, আপনারা গরু কেনার সময় কখনোই সাদা কালোর ওপর নির্ভর করবেন না। আপনারা সব সময় চেষ্টা করবেন মায়ের ইতিহাসে জানা এবং তার শারীরিক গঠন টা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে গরু ক্রয় করবেন।
এখানে আমরা উন্নত জাতের গাভী চেনার উপায় ও লক্ষণসমূহ বর্ণনা করলাম এগুলো মাথায় রেখে গাভী নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।